Saturday, February 12, 2022

স্মৃতিচারণায়

"Tis better to have loved and lost

Than never to have loved at all."

- Alfred Lord Tennyson, (In Memorium)


আজ রবিবার। ঠিক দু সপ্তাহ আগে শ্রী প্রহ্লাদ চন্দ্র প্রধান ইহলোক ত্যাগ করেছেন। ঘটনাচক্রে তিনি আমার মা র বাবা অর্থাৎ দাদু ছিল। আমি প্রায় মধ্যবয়সের দিকে এগিয়ে যাওয়া একজন পরিণত পুরুষ। কান্না আমার আসেনা। কিন্তু শেষ দুসপ্তাহ ধরে আমি কেঁদেই চলেছি। সারা জীবনেও এত কান্নাকাটি করেছি বলে মনে পড়ছেনা। আমার ভাই, যে ঘটনাচক্রে ডাক্তার আমায় পরামর্শ দিলো যে তোর মধ্যে মানসিক যে পরিবর্তন গুলো এসেছে সেগুলো মনে চেপে না রেখে যা মাথায় আসে ভাবনায় প্রকাশ করে লিখে ফেল। আমি নিজেও ভেবে দেখলাম, এরকম যদি আরও দু সপ্তাহ চলে, আমাকে ওষুধ খেতে হবে।  সুতরাং এই লেখার শুরু। লেখাটা আমায় নিয়ে নয়, লেখাটা ওই মানুষটার স্মৃতিচারণায়। চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিজের শেষ মধুরতা দিয়ে লেখাটা লেখার চেষ্টা করবো। শুধুমাত্র নিজের মনের ক্লেশ দূর করতে নয়, একটা মানুষকে লেখা দিয়ে যেটুকু বাঁচিয়ে তোলা যায় সেই চেষ্টা করবো। কোন কথায় কারো খারাপ লাগলে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী। 

লেখাটা শুরু করবো একটা স্বপ্ন দিয়ে। আমি ৩০ শে জানুয়ারি রাতে বিছানায় একা শুয়ে। আগের দিন থেকেই মন অস্থির ছিল,  মনে হচ্ছিল কিছু একটা খারাপ ঘটতে চলেছে। বেশ কয়েকজনকে মানসিক অস্থিরতা থেকে ফোন, মেসেজ ও করি। শেষে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সাধারণত ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পর আমার ঘুম আসতে এক ঘন্টা মত সময় লাগেই। কিন্তু সেদিন খাওয়া মাত্রই অলৌকিক ভাবে কোন এক যাদুবলে রাত ১০.৩০ টা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ি। মন এতটাই অশান্ত ছিল, ফোনটাও সুইচ অফ করে দিই। অস্বাভাবিক ভাবে আমি সেই রাতে একটা স্বপ্ন দেখি।  অন্য রকম স্বপ্ন। একদম পরিষ্কার। যেটা মনে পড়লেই আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারছিনা। আমার দাদু একটা সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পড়ে আমায় হাসতে হাসতে বলছে - এবার আমি এলাম তবে। 

আমি বলছি - কোথায় যাচ্ছ, আমাকেও নিয়ে যাও।

দাদু আবার হাসলো। একই কথা - এবার আমি এলাম। 

এই দাদুর বয়স একদম প্রবীণ। আর যেভাবে আমি ছোটবেলা থেকে পেয়েছি সবসময় হাসি মুখ। কিন্তু গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। 

এভাবে হঠাৎ যখন ঘুম ভাঙলো দেখলাম সকাল। তখনই বুঝলাম দাদু আর নেই। সুইচ অন করে মেসেজ দেখলাম সেটা সত্যি। যে দাদু আমায় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে কোন একভাবে ঠিক রাত সাড়ে দশটায় মারা যাওয়ার সময় দাদুর চেতনা আমার অবচেতন স্বপ্নে এসে বিদায় জানিয়ে গেলো। 

আমায় কেউ আগেরদিন খবর দেয়নি দাদু খারাপ আছে, পরে জেনেছি দাদু নাকি মারা যাওয়ার এক ঘন্টা আগেও খেয়েছে, কথা বলেছে। তবু আমায় ঘুমের মাঝেই স্বপ্নে শেষ বিদায় জানিয়ে গেলো অবিশ্বাস্য ভাবে। ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়, গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে৷ 

না এসব কথা আগে আমাকে কেউ বললে আমি বিশ্বাস করতাম না। হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু যখন নিজের সাথে হলো প্রায় অনেকক্ষণ থ হয়ে বসে ছিলাম বিছানায়। ওই সময়ের স্মৃতি একদম শূন্য। আমার মনে পড়ছেনা কি ভাবছিলাম। একবার মনে হল দাদু আমায় বলেছিল - আমি মারা গেলে আমার কানে এই মন্ত্রটা উচ্চারণ করিস ওম্ শান্তি: শান্তি: শান্তি: হরি ওম্ তৎ সৎ। 

কিন্তু আমি দাদুর মরদেহ দেখবো কিভাবে? দাদুর মরদেহের ছবিতে ঠিক সেরকমই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যেরকম আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। 


ঠিক কতটা গভীর সম্পর্ক ছিল দাদুর সাথে? 


আমার জীবনে যতজনের সাথে একটু গভীরে গিয়ে কথা বলেছি সবাই একই কথা বলেছে - আমি কিন্তু অন্যদের থেকে আলাদা। আমি একজন অন্য মানুষ। 

তাদের সবাইকে একই কথা বলেছি, আমি একজন সাধারণ মানুষ৷ এই অন্য মানুষটা হল আমার দাদু প্রহ্লাদ চন্দ্র প্রধান। 

 কোয়ান্টাম ফিজিক্স এ কোয়ান্টাম এন্ট্যাংগলমেন্ট বলে একটা কথা আছে। যখন অবজার্ভ করা হয়, দুটো এন্ট্যাংগল্ড পার্টিকেল একে অপরের কোয়ান্টাম স্টেট কে প্রভাবিত করে। 

দাদুর সাথে আমার সম্পর্ক সেরকম৷ দাদুকে নীলরতনে থাকাকালীন চিঠি লিখতাম। দুটো করে কপি বানাতাম, একটা পাঠাতাম, আর একটা নিজের কাছে রাখতাম।

একটা চিঠি পেয়েওছি, ছবিতে জুড়ে দিলাম। একদম ছোট থেকে শুরু করি যেটুকু স্মৃতি মনে পড়ে। 

আমি দাদুর সব থেকে বড় পৌত্র। একদম বাচ্চা বয়স থেকে বেশিরভাগ ভালো স্মৃতিই দাদুর সাথে মামাবাড়িতে। বাদবাকি মামা র সাথে।

ছোটবেলায় মাঝরাতে যখন উঠে কাঁদতাম, দাদু আমার প্রিয় ক্রিম বিস্কুট জলে ভিজিয়ে এনে খাওয়াতো বাবা মা র মতো। দাদুর স্কুলেও আমি গেছি আবছা আবছা মনে পড়ে। কখন দাদু ফিরবে। দাদুর কাছে কিছু গল্প শুনে এত প্রভাবিত হয়ে যাই, রামায়ণ মহাভারত খুব ছোটবেলায় পড়ে ফেলি। সব সময় এইসবই আলোচনা হত। মামাবাড়ি র সামনে বালির মধ্যে নুড়ি পাথর রাখা থাকতো। সেগুলো কে তুলে এনে কাউকে অর্জুন, কাউকে ভীম, কাউকে দুর্যোধন বানিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ খেলতাম। আমার সব থেকে প্রিয় খেলা ছিল ওটা। তখন দাদু যে ঘরে শেষে থাকতো ওই ঘরে বুড়ি দিদা আগে থাকতো, যাকে দাদু মা র চোখে দেখতো । তাকে আমি ভীষ্ম ভাবতাম। তাই ঝাঁটাকাঠি ভেঙে একদিন বুড়ি দিদার বিছানার চাদরের তলায় গোটা বিছানা দিয়ে ভীষ্মের শরশয্যা খেলেছিলাম। সারা রাত মানুষটা একবার এদিকে ফিরলে মট্, ওদিকে ফিরলে মট্ করে আওয়াজ হয়। সকালে উঠে আবিষ্কার হল আমার কান্ড। 

দাদু কিন্তু বেশ মজা পেয়েছিল ওটা দেখে। দাদুর খুব প্রিয় মানুষ ছিল বুড়ি দিদা। দাদুকে যেখানে পোড়ানো হয়েছে বুড়ি দিদাকেও সেখানে পোড়ানো হয়েছিল। বুড়ি দিদার মৃত্যুতে দাদু ভেঙে পড়েছিল। দাদু শেষ বয়স অব্দি এই গল্পটা মনে করে হেসে হেসে বলতো। আমারো পরিষ্কার স্মৃতি আছে। তখন আমি খুব ছোট। তারপর দাদু আমাকে কি বুঝেছিল জানিনা ছাত্র বানিয়ে নিল। দিনরাত বিভিন্ন লেখা নিয়ে আলোচনা হত। আধ্যাত্মিকতার হাতে খড়ি দাদুর হাতে। নয়-দশ বছর থেকে দাদুর মুখে কথামৃত, অরবিন্দ, Mira Alfassa ইতাদি শুনেছি। শেষ বয়সে দাদুকে যাই বলতাম দাদু এইসব প্রসঙ্গেই কথা বলতো। এটা বুঝেছিলাম, দাদু নিজেকে ঋষি অরবিন্দ আর বুড়ি দিদা কে হয়তো Mira Alfassa র চোখে দেখতো। তাই তাকে নিয়ে বই ও লিখেছে। যে চিঠিটার ছবি দিয়েছি সেটা এগারো বছর আগের লেখা, এরই একটা কপি পোস্ট করেছিলাম। কিন্তু কোন উত্তর পাইনি। জানিনা দাদু আদৌ পেয়েছিল কিনা৷ সেই নয় দশ বছর বয়স থেকে আমাকে চিঠি লেখা শিখিয়েছিল৷ ব্যাপারটা আমার খুব মজার লেগেছিল। চিঠিটা পড়লেই বোঝা যাবে, আমি দাদুর লেখা নিয়ে কতটা উত্সাহী ছিলাম। তবে উল্টোটাও সমান ভাবে সত্যি ছিল। আমার প্রথম কবিতা ওই নয়-দশ বছর নাগাদই লেখা হবে। প্রথম কবিতা লিখেছিলাম নিমকি নিয়ে, যেহেতু তখন নিমকি খেতে বেশ লাগতো। শেষ লাইনটা ছিল - "ক্লেশটা পেতাম যদি নিমকির পাহাড় /তবে আকাশ ছুঁয়ে হতাম পৃথিবী পারাপার। "

অতীব জঘন্য লেখা, এতটাই জঘন্য আর অপ্রাসঙ্গিক, এখানে আর দিলাম না। দাদু সেটাও পড়ে হেসে বলেছিল - বেশ বেশ, লিখতে থাক, রোজ লেখ। 

আমি সেরকমই লিখতাম। দাদু আমার লেখা ছোট গল্প নিয়ে স্থানীয় কোন ম্যাগাজিনে ছাপিয়েছিল। আমি একটু বড় হতেই যখনই মামাবাড়ি ঢুকতাম, আমাকে কোথা থেকে কোন বই এর কি লেখা, ম্যাগাজিনে কি লেখা বেরিয়েছে পড়াতো। আমি ওইগুলো পড়ে আমার মত সমালোচনা করতাম। দাদু আরও উত্সাহে আরো লেখা দেখাতো। একদিন দাদুর সাথে জোর তর্ক হচ্ছে, দাদু বলছিল - মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। 

আমি বললাম - এই পাপ টা না করলে এই পৃথিবীতে ঠকে যেতে হবে। 

দাদু মারা যাওয়ার পর আমি যখন মামাবাড়ি তে যখন ঢুকলাম দিদা আমায় জড়িয়ে কাঁদছিল, কি যে ভালোবাসিতো তোরে। 

না আমি ভাঙিনি। 

তারপর একজন এসে বললো - কাকা ( মানে আমার দাদু) একজন নাতির কথা বলতো, সে খুব তর্ক করতো। সে বলেছিলো মানুষকে বিশ্বাস করলে পৃথিবীতে ঠকতে হবে। 

দিদা আমাকে দেখিয়ে বললো - কে আর হবে, অউ হবে। 

আমি তাকালাম বাইরের খাট টার দিকে। ওখানে বসে এই একদম এই কথাগুলো হচ্ছে আমার মাথায় ফ্ল্যাশব্যাক হলো। না ওই খাটে এখন দড়ি দেওয়া। কেউ নেই ওখানে। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ওখানেই কান্নায় ভেঙে পড়লাম তাসের ঘরের মতো। 

স্মৃতির মণিকোঠায় টান মারলে এই কিছু স্বর্ণোজ্জ্বল স্মৃতিই মনে পড়ে। একদিন জোর তর্ক হচ্ছে বঙ্কিম বড় না রবীন্দ্রনাথ? প্রসঙ্গ বঙ্কিমের বন্দেমাতরম কে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে সমালোচনা করেছে যে দেশকে দেশ হিসেবেই ভালোবাসবো। তাকে মা ভেবে সেন্টিমেন্টে কাঠি করবো কেন? আমি বিপক্ষে বলছিলাম। মা আমাকে বঙ্কিম পড়তে দেয়নি বলে দাদু মাকে বারণ করেছিলো। বলেছিল - এডাল্ট লেখা পড়ার আবার বয়স হয় নাকি? 


ততদিনে দাদুর ছাত্র থেকে শিষ্য হয়ে গেছি। দাদু আমায় ছোট গল্প কিরকম হওয়া উচিৎ শিখিয়েছে, উপন্যাসে কিভাবে বিভিন্ন লেখক চরিত্র দিয়ে রামধনু বানিয়েছে অথবা কবিতার মাধ্যমে কিভাবে গোমুখের কান্না কাটি কে শিবের জটায় ধারণ করা সম্ভব সব কিছু র হাতেখড়ি দাদুর কাছে। 


এই দাদুকেই একদিন বলছিলাম দাদু একটা লাইন শোনো - 

"ভাষাহারা বুকে স্বপ্নের বিদ্রোহ, 

মেলাবেন তিনি মেলাবেন। "

দাদু বললো - কার লেখা? 

আমি বললাম - অমিয় চক্রবর্তী। 

দাদু বললো - আর এসব লেখা তোরাই পড়। ভালো।

 

বলে দাদু রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন এ ঢুকে গেলো। 

আমার একটা লেখা দাদুর খুব পছন্দ হয়েছিল। লেখাটিতে প্রথম আমি একটু হলেও নিজস্বতা আনতে পেরেছিলাম। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে লেখা। লেখাটা ছিল এরকম -

" আমি একটা প্রজাপতি। জানালার গ্রিল আর মশারির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে নারকেল পাতার ঝালরের সেলামি। যার পাতাগুলি বইয়ে পড়া ব্যাক্টেরিওফাজের পুচ্ছতন্তুর ন্যায়। পেছনে কাটা কাটা কলাগাছ। বাতাস বইছে ঝির ঝির করে। ঝুমকির ন্যায় শব্দ হচ্ছে। আমি পাতার অন্ধকারে কোণের ফাঁকে ফাঁকে উড়ে চলেছি। সামনে ম্যালেরিয়া গাছ। একটা জায়গায় বালির স্তূপ পড়ে।ওখানে রোদ এসে পড়ছে। পাখিরা কিচির মিচির করছে। একি,কিসের শব্দ হচ্ছে। কুড়াল দিয়ে কারা পেয়ারা গাছটা কাটছে? একি একটা হাত আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন? "


লেখাটার বিষয় বলি এবার। দাদুর মাথায় টাকে একদিন তবলা বাজাচ্ছিলাম। দাদু আমাকে তখন পরিবেশের উপর প্রবন্ধ লিখতে বলেছিল। আমি দাদুর পাশে মামাবাড়ি র বারান্দায় খাটে বসে এই কটা লাইন লিখেছিলাম। দাদু এটা পড়ে বলেছিল - এটা ঠিক লেখা হয়নি। একটা পেন্টিং হয়েছে। 

লেখাটির একটা ছবি দিলাম। 


এরপর আসি "বলাই" এর কথায়। একদিন দাদু বললো - বলাই তো পড়েছিস। কি মাথায় আসে বল। 

আমি বললাম। কি বলেছিলাম মনে নেই। তবে গীতার আত্মা থেকে জগদীশ বোস অব্দি আমি পৌঁছেছিলাম। দাদু তার উত্তরে একটা কবিতা বলেছিলো - 

অজাতভুবন ভ্রূণ মাঝে যখন বিলীন হয়েছিনু ওই বিরাট জঠরে, 

ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে মুদ্রিত রইয়া গেছে। 

আমি শুনে বললাম - এতো সমুদ্রের বুকে প্রাণের জন্ম। তাহলে গাছের গায়ে কান পাতলে সমুদ্রের শব্দ শুনতে পাবো? 

দাদু বললো - হ্যাঁ কেন পাবিনা? চাইলেই পাবি, সেরকম ভাবে শুনতে চাইলেই পাবি। 


দাদু নিজে শেষ বয়সে সাদা জ্যোতি হ্যালুসিনেট করতো। আর আমায় শব্দ শুনতে শেখার, আবেগের কম্পাংকের অংক মাপতে শেখা অনেক ছোট বয়সে তার ভিত গড়ে দিয়েছে। দাদু না থাকলে আমি গান ও লিখতে পারতাম না । দাদুর সেইসব লেখা পছন্দ ছিলোনা যেগুলোতে প্রচুর চরিত্র, দর্শন কম। যদিও দাদুর শরৎচন্দ্রের লেখা খুব পছন্দ ছিল।  কারণ যারা শরৎচন্দ্র পুরো পড়েছে তারা জানে, চাইলে কি সাহিত্য তিনি লিখতে পারতেন। 

তিনি যেচেই রবীন্দ্রনাথ হতে জাননি, দাদু বলতো। 

সংসারে যারা শুধু দিল, পেলনা কিছুই তাদের জন্য তার লেখা। 

যেদিন দাদুকে বলেছিলাম দাদু আমার কিন্তু তারাশঙ্কর কে শরৎচন্দ্র এর থেকে ভালো লাগছে। দাদুর মুখ ভার হয়ে গেছিলো। শরৎচন্দ্র হয়তো দাদু কে দেখলে দাদুকে নিয়েও লিখতেন। 

কিছু কিছু জায়গায় প্রত্যেকটা মানুষ বায়াসড্ হয়। যেমন,"ফটিক" লেখাটার উপর দাদুর আলাদা আবেগ ছিলো। 


দাদুর টাকে তবলা বাজাতাম আর বলতাম - দাদু তুমি দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ। 

এটা নিয়ে আমার একটা লেখাও আছে -

" আনিবনা শুধু প্রভাত,/

আনিবো সুপ্রভাত।/...... / সমাজ জাহাজ তরিবে জীবন পারাবার সুষ্ঠুভাবে,/হবো রাক্ষসকুলের প্রহ্লাদ, জগৎ মুক্তি পাবে। " 


লেখাটা যদিও ২০০৬ সালের। 

দাদু লেখাটা পড়ে বেশ মজা পেয়েছিল। 


জীবনীসাহিত্যে বা সমালোচনামূলক প্রবন্ধে দাদু অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলো। তবে একজন প্রকৃত সমালোচক হিসেবে দাদুকে খুব সৃজনশীল বলতে পারছিনা। দাদুর লেখা বেলুড় মঠে থেকে প্রকাশিত "উদ্বোধন" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকবার। অদ্বৈতবাদ, শংকরাচার্য, উপনিষদ নিয়ে দাদুর খুব গভীর জ্ঞান ছিল। যে মানুষটা লিখতে পড়তে এত ভালোবাসতো সেই কাজটা সে যদি মুক্ত মনে শারীরিক কারণে করতে না পারে সে যে কি হতাশা সেটা আমি বুঝতে পারতাম। দাদুকে একবার বলেছিলাম এই যে তোমার সাথে এইসব কথা হয়, এটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটা লেখা লিখে গেছে। 

দাদু বললো - কি? 

আমি বললাম - 

" খাঁচার পাখি ছিল    সোনার খাঁচাটিতে,    বনের পাখি ছিল বনে।

        একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,    কী ছিল বিধাতার মনে।

         বনের পাখি বলে, ‘খাঁচার পাখি ভাই,    বনেতে যাই দোঁহে মিলে।’

         খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি আয়,   খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।’

         বনের পাখি বলে, ‘না,   আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।’

         খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়,   আমি কেমনে বনে বাহিরিব।’ "


দাদু শুনে হাসতো। দাদুকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য হাতের সামনে যা পেয়েছি পড়েছি। একদিন দাদুকে বললাম - দাদু, এই যে লেখাটা এটা কি মানে হতে পারে? 'তোমার হল শুরু, আমার হল সারা। '

দাদু বললো - তোর কি মনে হয়? 

আমি আমার মতো একটা মানে বললাম। 

দাদু বললো - এত সোজা নয়। তাহলে এই লাইন টা কেন? তোমার আছে ডাঙা, আমার আছে জল? 


আমি সেখানে রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরী দেবীকে টেনে আনলাম। দাদু সেখানেও মুখ ভার করে বসে রইলো। আজও উত্তর টা পেলাম না। 

দাদুকে আমি এইভাবে চিনেছি। আমি যখন লেখায় অনেক সাবলীল হলাম, কথায় কথায় সারকাজমের পাঞ্চ, ছন্দমিল কিংবা শব্দের মায়াজাল দাদু তখন অনেক বৃদ্ধ। আর পুরোপুরি অরবিন্দ আর Mira Alfassa কে নিয়ে মগ্ন। অনেক চেষ্টা করেও দাদুকে আধুনিক সাহিত্য যেমন সুনীল কিংবা নারায়ণ সান্যাল পড়াতে পারিনি। দাদু মানে রোমান্টিক লেখা কিংবা ট্রাজেডির আর্তনাদ অথবা প্রকৃতির কুহেলিকা নিয়ে জলপ্রপাতের মত কবিতা। 


দাদু আমার কাছে এক অদম্য উদ্যম কবিতা লেখার। তাকে হারিয়ে আমি হারিয়ে যেতে বসেছি। দাদুর দেওয়া নিজের বইগুলোর দিকে ছলছল চোখে দিনরাত তাকিয়ে আছি। মৃত্যুর পর সব শেষ। সব কিছুর উপরে এখন দাদুর চেতনা। নাহলে একবার অন্ততঃ আমায় সান্ত্বনা দিতে আসতো। 

 জন্মালে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই অন্ধকারে আমি দাদুকে হারানোর জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না। 

দাদুর জন্য আমার প্রিয় কটা লাইন রইলো -


"Be near me when my light is low,

When the blood creeps, and the nerves prick

And tingle; and the heart is sick,

And all the wheels of Being slow.


Be near me when the sensuous frame

Is rack'd with pangs that conquer trust;

And Time, a maniac scattering dust,

And Life, a fury slinging flame.


Be near me when my faith is dry,

And men the flies of latter spring,

That lay their eggs, and sting and sing

And weave their petty cells and die.


Be near me when I fade away,

To point the term of human strife,

And on the low dark verge of life

The twilight of eternal day."


- Tennyson



দাদুর মৃত্যু একদম শান্তিতে হয়েছে। একদম শান্ত মুখ। মুখে কোন কষ্ট নেই। অপ্রাপ্তি নেই। এখান থেকেই বোঝা যায় দাদু একজন মহর্ষি ছিল। আরো কত এরকম স্মৃতি। শেষদিকে এসে বলবো সেরকমই একটা দাদুর প্রিয় লাইন দিয়ে -

" For oft, when on my couch I lie

In vacant or in pensive mood,

They flash upon that inward eye

Which is the bliss of solitude; "


লাইনগুলো ড্যাফোডিল ফুলের জন্য ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর লেখা ৷ দাদু আমায় এত জ্ঞান নিঃস্বার্থভাবে বিকিরণ করেছে, আমি চির ঋণী। দাদু শুধু আমার আত্মীয় ছিলোনা। আমায় এত ভালো বুঝতে আর কেউ কখনো পারেনি। এত পবিত্র মানুষটার ভাষা। এত পবিত্র সহজ তার মন। দাদু একটা ফুলের মতো, যে শুধু দিতে জানতো, বিনিময়ে কখনো সেভাবে আমায় কিছুই চায়নি। আমাকে নিয়ে চরম অহংকার ছিলো মানুষটার। আমি সেখান থেকে আমার আত্মবিশ্বাসের ভিত তৈরি করেছি৷ সব আজ ভেঙে চুরমার।

দাদুর স্মৃতি কি আমার কাছে ড্যাফোডিল এর থেকে কোন অংশে কি কম? একটা পেন্টিং করা যাক্। 


ধরা যাক্, একজন সৈনিক যে আহত, ক্লান্ত, রক্তাক্ত। সে বরফশীতল রাত পেরিয়ে সকালের আলোতে একটা সাদা ফুল দেখে বলে উঠলো -

" Edelweiss, Edelweiss -

Every morning you greet me,

Small and white, clean and bright,

You look happy to meet me.

Blossom of snow, may you bloom and grow

Bloom and grow forever. "


দাদু সেদিন সেই সৈনিক ছিল, আজ আমি সেই সৈনিক। 

দাদুর সাথে আমার সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিল। "তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।"


শরীরের মৃত্যু আছে, আত্মার নেই। 'ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে'।। 


No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...