Sunday, July 30, 2017

অমীমাংসিত

আজ থেকে অনেক বছর আগে মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ের কথা। বাইরে থেকে আগত মুসলিমরা যেসব হিন্দুদের ঘর থেকে উত্খাত করে, তারা এসে হিমালয়ের দুর্গম এলাকায় এসে স্থান নেয়। কেউ যুদ্ধকলা শেখে শুধু আত্মরক্ষার্থে আর বুদ্ধিস্ট মঠে স্থান নেয়। কেউ শিবের আরাধণা করে অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। এরকমই একটি দলের কথা আজ বলবো। হিমালয়ের কোলে এক দুর্গম এলাকায় এদের ঘাঁটি। প্রতি মাসে এরা তরবারি নিয়ে মুসলিম নিধন যজ্ঞে বেরোয়। একদিনে যে যত মুসলিম মারতে পারবে সে তত উঁচু পদ পাবে। এদের দলের সর্দারের নাম মহাদেব। সবাইকে তরবারি চালনা আর যুদ্ধবিদ্যা শেখায়। মহাদেবের ভক্ত। তাই নাম ও একই। এর প্রধান শিষ্য হল শম্ভু। জন্ম দেবীপক্ষে। তাই নিজেকে মহাদেবের অংশ বলে কল্পনা করে বিশেষ সন্তোষ লাভ করে। তরবারি বিদ্যা বা যুদ্ধবিদ্যায় এর সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবেনা। একাই কুড়িজনকে নিমেষে শেষ করার ক্ষমতা রাখে। ছোটবেলায় ওর বাবা-মা কে কোন মুসলিম মেরেছে তাই ওর জীবনের লক্ষ্য মুসলিমদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করা। চোখের জল তো দূরের কথা, একজন যুবকের মুখে যেটুকু অনুভূতি থাকার কথা সেটা এর মুখে নেই। একদম ভাবলেশহীন।
আজ সেই দিন। রাত হতেই আবার বেরোল তারা তরবারি নিয়ে। সামনে একটা মুসলিম বসতি দেখে তারা একটু দূরে ঘোড়াকে গাছে বাঁধল। সবাই গাছের তলায় বসে গঞ্জিকা সেবন করলো। তারপর 'হর হর মহাদেব' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওই বসতিতে। শম্ভু একের পর একজনের মুণ্ডছেদ করার পর হঠাৎ একটি বাড়ির ভেতরে এসে থমকে গেল। একটা আওয়াজ শুনে। সে এগিয়ে গেল আওয়াজ লক্ষ্য করে। একজন মুসলিম তার দিকে তরবারি নিয়ে এগিয়ে এল। তাকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল শম্ভু। মুখে বলল - ওম্ নম: শিবায়।
আর একই সংগে আবার সেই আওয়াজ। ঠিক ওম্ নয়। 'ওঁয়া'। এরকম আওয়াজ আগে কখনো শোনেনি সে। একটা আওয়াজেই সে পরিচিত। মর্মবিদারী প্রাণনাশি 'আ আ আ'।
আবার হল ওঁয়া।
এগিয়ে এসে থমকে গেল। একটি শিশু কাঁদছে। তাকে দেখেই কান্না থেমে গেল।
শম্ভু বললো -ওম্ বল্। নাহলে আমার তরবারি তোর গলা কাটবে।
শিশুটি খিলখিল করে হেসে উঠলো। শম্ভুর তরবারিটি তখনো রক্ত মাখা। লাল রং এর দিকে আকর্ষিত হয়ে শিশুটি হাত বাড়ালো। যথারীতি তরবারির ধারে শিশুটির হাত কেটে গেল। আবার কান্না শুরু করলো। শম্ভুর হঠাৎ কি মনে হল। শিশুটিকে কোলে নিয়ে তার আংগুলটা নিজের মুখে চেপে ধরলো রক্ত বন্ধ করার জন্য। তারপর তাকে কোলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। সে আগে কখনো শিশুর কান্না শোনেনি। তাকে ছোট থেকে একটি আওয়াজের সাথেই পরিচিত করা হয়েছে। তাই সে বুঝলো এ মুসলমান বসতিতে থাকলেও ওম্ বলে। এ ভালো। একে মারতে পারবেনা সে। কিন্তু একে নিয়ে ফিরে গেলে ওরা মেরে দেবে। তাই বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘোড়াতে চেপে কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশের পথে রওনা দিল। অনেক পথ ঘুরে সে একটি পাহাড়ের কোলে কুটিরের সন্ধান পেলো। ঘোড়াটা গাছে বেঁধে সে কুটিরে কিছু খাবারের আশায় গেলো। দরজার বাইরে ডাকাডাকি করতে একটি মেয়ে বেরিয়ে এল। মেয়েটি অসাধারণ দেখতে। কিন্তু জীবন সংগ্রামের ছাপ আষাড়ের মেঘের মত তার মুখের লাবণ্যকে ঢেকে রেখেছে। অন্য কোন যুবক হলে ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারতো না। কিন্তু শম্ভু এভাবে ভাবতে শেখেনি। তার একটা হাত সবসময় তরবারির খাপে থাকে। আর ইন্দ্রিয়গুলো ভালো লাগার অনুভূতি ভুলে শত্রুর জন্য সদা সজাগ থাকে। এরকম অবস্থায় সে বুঝতে পারলো তাকে পেছন থেকে কোন দুর্বল কাঠের চেলা নিয়ে কেউ পিঠে আঘাত করতে আসছে। কিন্তু সে কোন আপত্তি করলোনা। মার খেয়ে প্রচুর লেগেছে এরকম ভাব দেখিয়ে সে মাটিতে বসে পড়লো। তার কোলে বাচ্চা দেখিয়ে হাঁ হাঁ করে উঠলো মেয়েটি।
' আরে দাদা কি করছো, দেখছো কোন ভালো মানুষ, কোলে বাচ্চা।'
পেছন থেকে আক্রমণকারী দাদা বললো -" ভালোমানুষ! ওই দেখ তরবারি। হাতে রক্ত। "
শম্ভু বলে উঠলো - 'দেখুন আমি একজন শ্রমিক। আমার পরিবারকে মেরে দিয়েছে ওরা। এ আমার ছেলে। আমাদের আশ্রয় দিন।'
তারপর থেকে শম্ভু ওদের বাড়ির পাশে একটা ছোট কুটির বানিয়ে থাকে। শম্ভু আর মেয়েটির দাদা মিলে পাহাড়ের কোলে চাষ করে আর সন্ধ্যে হলে তিনজন গল্প করে। বাচ্চাটির বয়স এখন এক বছর বেড়ে গেছে। শম্ভু এদের কাছে এসে জানলো রক্তপাত আর যুদ্ধ ছাড়াও মানুষের মধ্যে কিছু আলোচনা থাকতে পারে। সন্ধ্যেবেলা একদিন মেয়েটি এসে তাকে বললো,আমার সাথে আসুন।

বলে তাকে সামনের ঘাসের উপত্যকা পেরিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। যেটা খাড়া নিচের দিকে নেমে গেছে। দূরে পাহাড়ে র খাঁজে চাঁদ উঠেছে। আর সেই আলো মেয়েটিকে অপরূপ সুন্দরী করে তুলেছে। শম্ভু অনুভব করলো তার হৃদয় অশান্ত হয়ে উঠেছে। সে ওখানেই ছিলাম বের করে গঞ্জিকা সেবন করতে শুরু করলো। আর মেয়েটি বকে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে সে অনুভব করলো সে মেয়েটির কথা খুব মন দিয়ে শুনছে। কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তে আগে কি বললো খেয়াল করতে পারছেনা। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো।
মেয়েটি তাকে বললো - ওই শুনছেন ? ওই ওই।
বলে যেতে লাগলো।
সে অনুভব করলো, ওম্, ওঁয়া আর ওই -
সব একসাথে মিশে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে।

শম্ভু লক্ষ্য করলো মেয়েটির গালে তার মাথার চুল এসে বাঁধা সৃষ্টি করছিল। সে তার হাত দিয়ে তার চুলটাকে সরিয়ে দিল।
মেয়েটি অবাক হল না। বাঁধাও দিলনা। বরং মেয়েটি তার হাত শম্ভুর বুকে রেখে বললো - আমারও ভেতরে একি রকম চঞ্চল।
মেয়েটি শম্ভুকে চুম্বন করলো। শম্ভু সেই সন্ধ্যেতে অনুভব করলো, একটা ঠোঁটের স্পর্শ তরবারির থেকেও ধারলো। অনেক গভীরে পৌঁছায়। আর এই শক্তি পৃথিবী জয় করার ক্ষমতা রাখে।
মেয়েটি বললো - " আমরা মুসলিম। আমি যখন খুব ছোট দাদার মুখে শুনেছি হিন্দুরা আমাদের বাড়ি থেকে উৎখাত করে। আমার হাল্কা হাল্কা মনে পড়ে। তুমি নিজের অতীত সম্পর্কে কখনো কিছু বলোনি সেভাবে। "
শম্ভু কিছু বলতে যাবে হঠাৎ কিছু অশ্বারোহী এসে সেখানে পৌঁছালো। তাদের দুজনকে ঘিরে ধরলো। শম্ভুর কাছে তরবারি নেই। দুজন অশ্বারোহী কুটিরের ভেতর থেকে মেয়েটির দাদাকে বের করে আনলো। একটি ঘোড়া থেকে মহাদেব নামলো। গম্ভীর কন্ঠে বললে -
" শম্ভু আমার সব থেকে প্রিয় শিষ্য । বহুদিন ধরে খবর পাচ্ছিলাম যে তুই কোন এক পাহাড়ের কোলে দুজন মুসলমানের সাথে আছিস। তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে। তুই জানিস বিধর্মীদের সাথে মেশা আর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কি "
শম্ভু হাতজোড় করে বললো - "আমি জানি। মৃত্যু। আপনার কাছে আমার কিছু বলার আছে।"
মহাদেব ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলতে বললে।
শম্ভু বললো - আমায় ছোট থেকে কখনো শেখানো হয়নি একটা শিশুর হাসি কি। একটা শিশুর আংগুল কেটে যখন রক্ত বেরোয় তার স্বাদ নোনতা। যেরকম আমার আংগুল কাটলেও। সে ওম্ উচ্চারণ করতে পারেনা। কিন্তু ওঁয়া বলে। মন থেকে বলে। একটা শিশুর কোন ধর্ম থাকে না। আমরা তার উপর ধর্ম আরোপ করি। আমার ধর্ম হিন্দু নয়। আমার ধর্ম প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে মানুষ খুন করা। আমি শিখেছি ভালোবাসা কি। আমাকে মেরে ফেলা হোক। কিন্তু এদেরকে ছেড়ে দেওয়া হোক।

মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠলো- না তুমি আমাদের ঠকিয়েছ। তুমি একজন খুনি। হিন্দু। তোমরাই আমার বাবা-মা কে মেরেছো। আমি তোমাকে ভালোবাসিনা। ঘৃণা করি।

বলে কাঁদতে লাগলো।
মহাদেব এবার ঘোড়া থেকে নেমে পা তুললো মেয়েটিকে আঘাত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। শম্ভু এবার মহাদেব কে আটকালো। মহাদেব আর তার সাথীরা তরবারি খুলে শম্ভুকে আক্রমণ করলো। শম্ভু তরবারি ছাড়াই তাদেরকে ধরাশায়ী করলো তার নিজস্ব নৈপুণ্যে। তাদের দুজনকে বললো - "আপনারা চলে যান, ঘোড়াটা নিয়ে আর আমার বাচ্চাটির খেয়াল রাখবেন। আমার বাচ্চাটি একজন মুসলমানের। ওর বাবা-মা কে আমি মেরে ফেলেছি।আমি বেশিক্ষণ এদের আটকে রাখতে পারবোনা। যান "
বলে তাদেরকে যেতে বললো।
মেয়েটির দাদা ছুটে বাচ্চাটিকে ঘর থেকে বের করে একটি ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটি ঘোড়া নিয়ে ফিরে এল শম্ভুর কাছে। "আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা।" মেয়েটি বললো।

শম্ভু মেয়েটির ঘোড়াতে উঠলো। কিন্তু বেশিদূর তারা যেতে পারলোনা। মহাদেবের দল তাদের আটকে ফেললো। শম্ভু কে তরবারির আঘাতে দুর্বল করলো। তারপর তাদের দুজনকে চাবুকে গলা বেঁধে শ্বাসরোধ করে মৃতপ্রায় করে তোলা হল। মহাদেবের তরবারি যখন দুজনের গলা লক্ষ্য করে আসছে। দুজনে তখন দুজনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মেয়েটি শম্ভুর হাত আঁকড়ে ধরলো।

বললো - আমার কথায় আঘাত পেলে ক্ষমা কোরো আমায়।

শম্ভু বললো - আমায় মনে রেখো।

দুটো কাটা মাথা নরম ঘাসের উপর গিয়ে পড়লো। কাটা মাথা থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল দুটোর রংই লাল। ভালবাসার রং। তাই মিশে গেলো।

**************
"কি দাদা, মন টা কি সোনাগাছিতে ? "
আরেকটু হলে পেছনের গাড়িটা গায়ে এসে পড়ছিল। দোষটা শতদ্রুর ই, তাই কথাটা হজম করে নিল। সে সত্যিই অন্যমনস্ক। আজকেই তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের কোম্পানি থেকে, অডিটে একটা প্রশ্ন করার জন্য। প্রশ্ন করলেই কেন মাদার গাছের তলা আঁধার হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথই শুধু বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো ইহলোকে আর নেই। আজে বাজে ভাবতে ভাবতে একটু এগিয়ে পেছন দিকে তাকালো আবার কোন গাড়ি আসছেনা তো। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। সেই স্ট্রিট লাইটের আলোয় সে পরিষ্কার বুঝতে পারলো পেছন দিকে তাকিয়ে কেউ তাকে পিছু করছে। সে হাঁটার গতি বাড়ালো, কিন্তু তার সাথে সেই অজানা ব্যক্তিটিও গতি বাড়ালো। আর একটু দূরেই শতদ্রুর বাড়ি। এক দৌড়ে সে চলে গেল বাড়ির গেটে। তাড়াতাড়ি গেট টা লাগিয়ে হাঁফাতে লাগলো। একটা সিগারেট প্রচন্ড রকম দরকার। জল খেয়ে পাখা টা ছেড়ে চেয়ারে শরীর টা এলিয়ে দিয়ে সিগ্রেট টা ধরালো । কে পিছু করতে পারে। তার শত্রু কে আছে ? ধুস এত টানছে ধোঁয়া আসছে না।
সিগ্রেটটা ধরেনি নাকি? ধুস্ এ তো সিগ্রেটের ফিল্টারে আগুন ধরিয়ে বসেছে সে। পুরো সিগ্রেটটাই নষ্ট তার অন্যমনস্কতার জন্য। সিগ্রেটের ভুল দিকে আগুন ধরানো অনেকটা যেন ... এক মিনিট। তাই তো, ভেবে দেখেনি। লোকটা সমকামী নয় তো ? তার পিছু নিয়েছিল হয়তো। হঠাত্ কলিংবেল টা বেজে উঠলো। দরজার ফুটো দিয়ে দেখলো সেই লোকটা। দরজার এপার থেকে চেঁচিয়ে শতদ্রু বললো - দেখুন, আমি আপনার মত নই। প্লিজ আপনি অন্য কারো পিছনে যান।
ওদিক থেকে লোকটা হেসে বললো - আরে আপনিও যা ভাবছেন আমি তা নই। আপনাকে দেখে চেনা মনে হল, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছেনা তাই পিছু নিয়েছিলাম। খুলুন না মশাই।
শতদ্রু আরো ভয় পেয়ে বললো -দেখুন, এসব ট্রিক্স পুরানো হয়ে গেছে। আমি কোনভাবেই আপনাকে চিনিনা।এভাবে রাস্তায় ছেলে দেখলে উত্যক্ত করা বন্ধ করুন। আপনার বাড়িতে বাবা - ভাই নেই?
লোকটা এবার আরো জোরে হেসে বললো - বাবা, ভাই আছে। আমার স্ত্রী- পুত্র ও আছে। কথা বলবেন ফোনে? ছবি দেখবেন? প্লিজ একবার আপনি দরজাটা খুলুন। আপনি আমার খুব চেনা। কিন্তু মনে করতে পারছিনা।
দুঘন্টা পর লোকটা যখন শতদ্রুর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো তখন শতদ্রু নিজের উপরই হাসছিল। লোকটা খুব ভালো লোক, কথা বলে শতদ্রুর ও মনে হল, খুব পরিচিত কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেনা। শতদ্রুর রাতটা হতাশায় না ঘুমানোর কথা ছিল, কিন্তু সে সেদিন সারা রাত ধরে এটাই মনে করে যেতে লাগল কোথায় এর আগে পরিচয় হয়েছে। লোকটাকে নিজের ফোন নাম্বার ও দিয়েছে।

পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা কলিংবেল এর আওয়াজ শুনে শতদ্রু এসে দেখলো সেই লোকটাই এসেছে।
লোকটাকে দেখে আজ মনে খুব আনন্দ হল। বলেও ফেললো -
আমার এখন খুব খারাপ অবস্থা চলছে, আপনাকে দেখে মনটা খুব ভালো হয়ে গেল।
- বলছেন কি ? তাহলে আজ আমরা একটু জলপান এর ব্যবস্থা করি।
- হলে তো ভালোই হত। কিন্তু আমার টাকাকড়ি খুব কম পড়ে আছে। তাই আমি গাঁজা খাই।
- বেশ তো। আমি মদ খাওয়াচ্ছি আজ। গাঁজাও খাওয়া হবে।
শতদ্রু এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল। দুজনের এক রাউন্ড মদ আর গাঁজা চলার পর লোকটা বললো - আচ্ছা আপনি এখনো বিয়ে করেন নি কেন ?
- বিয়ে!
বলে হাসলো শতদ্রু।
- এতে হাসির কি হল। আপনার এখন নাহলে খারাপ অবস্থা,কিন্তু সারাজীবন তো এরকম চলবেনা। একা একা কতদিন কাটাবেন।
- একা একা কেন, এই আপনার মত কেউ তো আছে যেন অনেকদিনের চেনা।
- আমি ও তো বিবাহিত। আমি কি রোজ আপনাকে সময় দিতে পারবো নাকি ?
- ছিল। আমার কয়েকটা সম্পর্ক কিন্তু একটাও বেশিদিন টেকেনি।
- কেন ?
- এরকম মনে হয় আমি কাউকে খুঁজছি। বুঝতে পারিনা কাকে ? তার সাথে যখন যার মিল খুঁজে পাই মনে হয় একেই। কিন্তু বুঝতে পারি আমি ভুল করেছি। আমার সাথে মেলেনা। ভেংগে যায়। হয় তার দিক থেকে, নাহয় আমার। তাই ভাংগার ভয়ে কারো সাথে আর এগোতে পারিনা। এখন একজনের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। কিন্তু সেই ভয়ে এগোতে পারিনা।
- আর তার ?
- সে এগোবেনা।
- হুম্, তার ছবি দেখতে পারি।
- নিশচয়ই। এই দেখুন।
বলে মোবাইলে একটা ছবি খুলে লোকটার দিকে এগিয়ে দিল। মোবাইলটি হাতে নিতে নিতে, লোকটি বললো, তা আপনি কাকে খুঁজছেন তার কোন বৈশিষ্ট্য ? তাকে চিনবেন কি করে ?
- জানিনা। কিন্তু খুঁজছি। একটা সবুজ ঘাসের মাঠ, সেই ঘাসের আগায় শিশির জমে। সামনে পাহাড়। আর ও। এই দৃশ্যটা আমি গাঁজা খেয়ে থাকলেই চোখে ভাসে। এখনো ভাসছে। অনেক চেষ্টা করি ও কেমন দেখতে চেনার, নাম জানার। আরো একটা দৃশ্য ভাসে ওই মাঠে অন্ধকার নেমেছে। কালো ঘাসের উপর আমি আর সে হাত ধরে হাঁটু মুড়ে বসে। ঘাড় থেকে রক্ত পড়ছে। একজনের লাথি। ঘোড়ার শব্দ। উফ্ আমি আর মনে করতে পারছিনা।
- একটা বাচ্চা, একটা পাহাড়ের কোলে দুটো কুটির।
- হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি কি করে জানলেন, আমিও দেখেছি।
- শতদ্রু বাবু আপনি অন্য জন্মে বিশ্বাস করেন ?
- হ্যাঁ করি।
- আমিও এই একই আবছা আবছা স্বপ্নের মত জায়গাটাকে দেখেছি। আমার মনে হয় আমরা অন্য জন্মে পরিচিত। নাহলে একদিনের আলাপে এতটা বিশ্বাস করে মদ খেতে বসতে পারতাম না। শুধু তাই নয় আমি এই মেয়েটিকেও চিনি।
- কিভাবে ?
- মনে করতে পারছিনা। কিন্তু আমি আমার স্বপ্নে একে দেখেছি। আমাকে দাদা, ভাইজান বলে ডাকছে। আমাকে আর এক রাউন্ড গাঁজা দেবেন ?
দুজনে আর এক ছিলিম শেষ করতেই লোকটির সব মনে পড়ে গেল। সে সব বলে দিল। তারপর কাঁদতে লাগল। শতদ্রু থ মেরে বসে রইল। একটা দীর্ঘনি:শ্বাস পড়ল তার। লোকটি বললো এই মেয়েটি আমার বোন ছিল। আমি নিশ্চিত। আপনার বাচ্চাটির কথা ভেবে আমি আর ফিরিনি। আমি ফিরলে আমার সাথে বাচ্চাটিকেও মেরে ফেলতো ওরা।
শতদ্রু বললো - আমার সব মনে পড়ে গেছে। আমি তাহলে এখন কি করবো ? আমার কথা তো ও বিশ্বাস করবেনা। এতদিন তো আমি ওর ভালো বন্ধু ই ছিলাম। কিন্তু এবার এসব মনে পড়ার পর। আর সম্ভব না বন্ধু থাকা।
- তুমি ওকে এসব কিছুই বলবেনা। ওকে শুধু তোমার মনের কথা খুলে বলো। তারপর ওর হাতে ছেড়ে দাও। চুপ করে যাও। ও যেটা ভেবে করার করবে।
- বলছেন ? কিন্তু আমি জানি ও কিছু বলবেনা।
- সব ম্যাচ তো কেউ হারে বা কেউ জেতে এরকম হয়না। কিছু ম্যাচ অমীমাংসিত থাকে। আবার পরের জীবনে রিম্যাচ হয়। যদি হওয়ার হয় ও বুঝবে। নাহলে আবার পরের জীবনে।
শতদ্রু মোবাইলটা নিল। হোয়াটস্যাপ রেকর্ডার অন করে মেয়েটিকে ভালোবাসি বলে কেঁদে ফেললো। তারপর
ফোনটা রেখে দিল। লোকটি বাড়িতে ফোন করে বললো - হ্যাঁ শোনো, আমি আজ আমার এক নতুন বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাবো।
বাড়ি ফিরবোনা। তোমার সাথে পরে আলাপ করাবো।
তারপর জড়িয়ে ধরলো শতদ্রুকে, আগের জীবনের হারানো বন্ধুকে,
" এই জীবনেও ও তোমার জীবনে খারাপ সময়েই এসেছে। ও ফিরে আসবে আজ না হোক কাল।"

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...