Sunday, March 15, 2020

নীলরতনের পাঁচ রতন | চতুর্থ পর্ব | All or None law।

অপর্ণার বাড়িতে কাঁপতে কাঁপতে আমি ঢুকলাম। বিশু কিন্তু অনেকটাই স্বাভাবিক ভাবে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অপর্ণাও তাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে উপেক্ষা করছে। ভগা ওদের বাড়িতে ঢুকেই ওয়াশরুমটা কোথায় বলে হাত মুখ ধুতে চলে গেল। আর নীল সোফাতে বসেই বললো - "খুব খিদে পেয়েছে না রে?"
বলে আমাদের দিকে তাকালো। যাতে আমরা সায় দিই। আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। খেতে কিছু দিলে তো খেয়েই নিতাম। কিন্তু এতটাও খিদে পাইনি যে নীলের মত নির্লজ্জ হয়ে বলতে হবে। বিশু নীলকে পাত্তা না দিয়ে অপর্ণা কে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা ঢুকলেন চারটে মিষ্টির প্লেট নিয়ে। অপর্ণা পরিচয় দিল ওর মা বলে।
বিশু সেই মুহূর্তে বলে বসলো - "কাকিমা ভালো আছেন? আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়, আপনার মেয়ের এরকম দেবীর মত গায়ের রং এর উৎস কোথায়?? "
আমি লজ্জায় মুখ লোকাবো না কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।
আমাকে এসে অপর্ণা ফিসফিস করে বললো -" শোনো, তোমার এই বন্ধুটিকে এবার থামতে বলো। নাহলে কিন্তু ঠিক হবেনা। "
এমন সময় একজন ভদ্রলোক গাউন পরে ঢুকলেন। হাবভাব দেখেই বোঝা যায় তিনি বাড়ির কর্তা মানে, অপর্ণার বাবা।  আমাদের হস্পিটালেরই শিশুদের ডাক্তার। একটা ব্যক্তিত্ব আছে। কিন্তু পুরো ব্যক্তিত্বর ১০৮ বার মেরে রেখে দিয়েছে একটি হিটলারী গোঁফ। উনি বোধহয় সুকুমার রায় কে একটু বেশি সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন, আর ওনার কোন হারামী বন্ধু নিশ্চয়ই উপদেশ দিয়েছিল যে ওই গোঁফে তোকে দারুণ মানাবে।
 উনি ঢুকেই বললেন - "কেন আমি কি খুব কালো? "
বিশু কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো - নিকষ কালো না হলেও কালো তো বটেই।
ভদ্রলোক চোখ গোলগোল করে তাকালেন। বিশু এবার বললো - "না বলতে চাইছি। কালো তাতে আপত্তির কি? এই ধীরুও কালো, ভগা ও কালো, নীল ও কালো। কালো মানে আলো। "
ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন। কিছুটা হলেও ম্যানেজ হয়েছিল পরিস্থিতি৷ কিন্তু ততক্ষণে ভগা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ও এত ঠোঁটকাটা এটা শুনেই বললো - " সে কি তুই তো কালকেই বললি, কালো টা কোন রং না। যখন কোন রং থাকেনা, তখন কালো দেখায়। "

বিশু বললো - হ্যাঁ কিন্তু সেটা ফিজিক্সের সত্যি। আসল আধ্যাত্মিক সত্যি এটাই, কালো মানে আলো।

ভগা আবার উত্তর দিলো - "সে কি রে তুই না আবিষ্কার করেছিলি গ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা কালো ছেলে জনির মুখ দেখলে দিন খারাপ যায়। এমনকি সে এত অশুভ যে উপর থেকে ওর মাথায় ইঁট ছুঁড়লে ইঁট নিজের মুখে এসে লাগে।"
সবাই চুপ।
আমি আর নীল ওই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত বুঝতে না পেরে মিষ্টি খাওয়াতে মনোনিবেশ করলাম। ওরা নিজেদের মধ্যে টুকটাক কিছু কথা বলছিল। মিষ্টি খাওয়া যখন শেষ হল তখন ভদ্রলোক বলছেন - "সেদিন যখন হস্টেলের পথে ফিরছিলাম ডিউটি সেরে, কে যেন আমার গায়ে গরম জল ফেলেছিল তোমাদের নর্থ উইং থেকে। আমিও তো এই হস্টেলেই থেকেছি একসময়। আমার মনে হয় ওটা তোমার ঘর থেকেই পড়ছিল। " বলে বিশুর দিকেই আংগুল তুললেন।
বিশু বললেন - "ওটা আমি না, রুমের অন্য কেউ হবে।"
স্যার বললেন - না আমি তোমাকেই দেখেছি৷

বিশু - ও তাহলে চা করার জন্য জল গরম করেছিলাম। এক্স্ট্রা গরম জলটা ফেলতে গিয়ে আপনার উপরে পড়েছে। রাস্তা অন্ধকার তো তাই আলো থেকে আপনাকে আমি দেখতে পাইনি, তাই হবে।
স্যার বললেন - হ্যাঁ, তোমার কেটলির নলমুখ টা আমি অন্ধকার থেকে দিব্যি দেখতে পেয়েছি।
আমরা কেউ কথাটা বুঝতে পারলাম না। অপর্ণা বললো - মানে?
ওর বাবা বললেন - উনি নিজের রুম থেকে নীচে মূত্র বিসর্জন করছিলেন।
বিশু এদিক ওদিক তাকালো। পুরো ঘর নিঃস্তব্ধ। হঠাৎ করে বিশু গিয়ে স্যারের পায়ের কাছে পড়ে গেল - "স্যার ভুল হয়ে গেছে, স্যার। আর হবেনা। আসলে আমি খুব অলস তো। সেদিন রুমে কেউ ছিলনা। তাই আর কি.. "
আমি, ভগা আর নীল তিনজনেই সাপোর্ট করলাম যে ও অলস।
আমাদের ধমকে বললেন - "শাট আপ। তোমরা বন্ধু হয়ে ওর এইসব কাজ কে সাপোর্ট করো। নেহাত আমার মেয়ে একটা ভুল কাজ করেছে নাহলে সুপারকে অভিযোগ জানাতাম। তোমরা এখন আসতে পারো। "
চারজন বিমর্ষ হয়ে ফিরছি হস্টেলে। এমন সময় নিরভ্র র সাথে দেখা। দেখা হতেই তার নির্দিষ্ট টোনে সে বললো - কি রে পেরিনিয়াম পড়লি?
আমরা কেউ কোন উত্তর দিলাম না দেখে বললো - "আমি ফেসবুক খুলেছি। তোদের ফেসবুক নেই? আমার অনেক বন্ধু৷ আমার ফটোতে আজ ২৫ জন লাইক করেছে। ইয়েস্। "
আমি এমনিতে শান্ত ছেলে। কিন্তু মাথা গরম হলে আমার মুখের আগে হাত চলে। আমি নিরভ্রকে মারতে গেলাম। ভগা আর নীল আমাকে চেপে ধরে থাকলো। বিশু বললো - কুল ডাউন ম্যান।
ব্যাস এবার আসল রাগের আউটবার্স্ট টা হল। বিশুকে তাড়া করলাম মারবো বলে। গোটা হস্টেল ছুটিয়ে নিয়ে গিয়ে যখন দুজনেই কুকুরের মত হাঁফাচ্ছি তখন আমাকে একটা লজেন্স দিয়ে বললো - চল্, ঠান্ডা হ এবার। আজ জনির মুখ দেখেছিলাম ক্যান্টিনে সবাই।

আমি কিছু না বলে লজেন্স টা নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। আমাদের দিনগুলো ছিল এরকমই। সকালেই চরম ঝগড়া, মার। বিকেলে গলায় জড়াজড়ি করে সিগারেটের কাউন্টার নিচ্ছি। এর মাঝে একটা নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছিল। বলা নেই কওয়া নেই আত্মীয়রা আমাদের ফোন করতো সকাল, বিকেল। আমরা ডাক্তারীর ড ও জানিনা তখন। আমাদের ফোন করতো যাতে আমাদের মাধ্যমে বেলাইনে ঢুকে ডাক্তার দেখানে যায় আমাদের হস্পিটালে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের এড়িয়ে যেতে হত। কারণ আমাদের পড়াশোনা করতে হত। যে না বলতে পারতো না সে সারা জীবন ওই দালালিই করে যেত। বছরের পর বছর ইয়ার ল্যাক খেতো। আর রিলেটিভ ব্যাপারটা সত্যি রিলেটিভ। যার সাথে শেষ দশ বছরে কোন কথা হয়না। এতদিন জানতামই না একে অপরের অস্তিত্ব। তারাও ফোন করতো তার বাচ্চা এক চামচের জায়গায় দু চামচ কফ সিরাপ খেয়ে নিয়েছে কি হবে। কেউ হয়তো কোনদিন খোঁজ নেয়না। সেও ফোন করতো তার বাচ্চার দুধ গরম করতে করতে দুধে চামচ পড়ে গেছে- এখন কি হবে?
এইসব উদ্ঘট প্রশ্ন। আমি আর নীল একসাথে ট্রেনে বাড়ি ফিরতাম। আমরা দুজনেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ছেলে। শুরুতে ট্রেনে যখন কেউ জিজ্ঞেস করতো - কোথায় পড়?
বুক ফুলিয়ে বলতাম নিজেদের পরিচয়। আর তখনই সেই প্রশ্নকর্তা বলতে শুরু করতো তার মাসীর কাকার পিসির নাতির ছেলে ও ডাক্তারী পড়ে৷ সে তার হস্পিটালের নাম্বার ওয়ান ডাক্তার। তা বাবা তোমাদের নাম্বার টা দাও তো।
শুরুতে দিয়ে দিতাম। তারপর বুঝলাম সমাজের নিয়ম। নিজেরা বাকি সমাজ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যেতে শুরু করলাম। আমাদের যেসব ক্লাসমেটরা স্কুলে গালাগাল দিতো তারাও ফোন নাম্বার জোগাড় করে চিকিৎসার পরামর্শ চাইতো। আমরা প্রত্যেকেই অল্পদিনে নাম্বার পাল্টাতে বাধ্য হলাম। আমাদের সার্কেলটা খুব ছোট হয়ে আসতে লাগলো ধীরে ধীরে।


যাই হোক, ইতিমধ্যে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম হস্টেলে একজন লাভগুরু দাদা আছে। নাম সত্যেন দা। সেদিন অপর্ণার কাছ থেকে ফিরেই সত্যেন দা র কাছে গেলাম। গিয়ে একটু অন্যভাবে আজকের ঘটনা টা বললাম। দাদা দশ টাকা ফিজ নিলো। তারপর বললো - শোন্, যে কোন মেয়েকে পটাতে গেলে আঁঠার মত সেঁটে থাকতে হবে। একদম ফেভিকুইক টাইপের। ঠিক পটবে।

দাদার সেই উপদেশ মেনে আমি রাতে অপর্ণার নাম্বারে মেসেজ করলাম। "আমার বন্ধু যা করেছে তার জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। "
মেসেজটা কি দেখলো, কিছু ভাবছে, নাকি পাত্তাই দিলনা, এইসব ভাবতে ভাবতে আমার পড়া লাটে উঠে গেল। একটু পরে রিপ্লাই এলো - আমিও সরি। আমার বাবা একটু বাজে ভাবেই চলে যেতে বলেছিল।

ব্যাস, আঁঠার কাজ শুরু। পুরো সেঁটে গেলাম। সারাক্ষণ ফোনে সেঁটে থাকতাম। গভীর রাত অব্দি গল্প চলতো। আমার বন্ধুরা আমাকে দেখলেই গান গাইতো - দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার ফোনের ওপারে।
আমি বাধ্য হয়ে দূরে চলে যেতাম। আমি আমার গোষ্ঠী থেকে দূরে চলে যাচ্ছি দেখেও আমি কিছু করতে পারছিলাম না। সামনে প্রথম সেমিস্টার। আর আমার প্রথম প্রেম। কাকে বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত বুঝতে পারছিলামনা।
ভগা একদিন সবাইকে ডেকে বললো - ভাই, ফার্স্ট সেম আসছে আমাদের গাঁড় মারার জন্য। আমরা এবার গভীর প্রস্তুতি শুরু করবো।
নীলের মাথায় সেই শিবেণের বাড়ি থেকে কনসেপ্ট করে পড়ার কথা মাথায় ঢুকেছিল। সে বললো - কিন্তু এরকম করে কি কনসেপ্ট হবে, বাল?
আমরা তাকালাম ওর দিকে। ও চুপ করে গেল। পড়াশোনা জোর কদমে চললো। সাথে প্রেম ও। আমার মনে হচ্ছিল আমার মত সুখী আর কেউ নেই৷ কখনো ভাবিনি আমার বন্ধুদের থেকে আমি দূরে সরে যাচ্ছি। ভাবলাম যেভাবে হোক সেমিস্টার শেষ করেই চুটিয়ে প্রেম করবো। কিন্তু সেমিস্টার শেষ করে বিছানায় এসে শুয়েছি, অপর্ণা মেসেজ পাঠালো - শোনো, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
আমি বললাম - কি?
- তোমার সাথে আমার সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব নয়।


আমি কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার আঙুলগুলো কাঁপছিল। অনেক কথা মাথায় আসছিল। এই তো কালকেই আমাকে মেসেজ পাঠালো আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবেনা। আজ হঠাৎ কি হল?  তাহলে কি বাবা সমস্যা? না সেটাও তো বলেছিল ওর বাবা আমাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে খুশি। তাহলে? এসব ভাবছি। আবার মেসেজ এলো - তবে তুমি যদি বন্ধু থাকতে পারো, আমার কোন আপত্তি নেই।
মেয়েটা বলে কি? আমি উত্তর দিলাম - "এটা সম্ভব নয়। আজকেই পরীক্ষায় একটা টীকা এসেছিল- All or none law..  উত্তরটা আমি লিখে এসেছি। আমার জীবনেও একই নীতি। Either All or None.. ভালো থেকো। "


(To be continued)
(Share the story with your friends if you like it.. Follow the blog to stay connected) 

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...