Saturday, March 7, 2020

নীলরতনের পাঁচ রতন | তৃতীয় পর্ব | Einthoven's law|

ফিজিওলজি ক্লাস চলছে, ক্লাসের পরে শিবেনের বাড়ি গিয়ে আমাদের পাঁচজনের প্রথম শিবের প্রসাদ সেবন করার কথা। তার কারণ দাদারা হস্টেল থেকে দুমদাম জুনিয়রদের তুলছে, ফ্রেশারস্ এর কাজ করাবে বলে। দাদা দের দাবী - তোদের আমরা ফ্রেশারস্ ওয়েলকাম দেবো আর তোরা কাজ করবিনা??
আমি ক্লাসের মাঝেই এসব নিয়ে ভাবসাগরে ডুবে গেলাম।
আমাদের মত ছেলেরা দাদাদের সব থেকে বড় টার্গেট৷ খুব সহজে ম্যানিপুলেট করে ফাই ফরমাশ খাটানো যাবে। একটু লাইমলাইট আর মেয়েবাজির লোভ পেলে দাদা হতে কে না চায়।
 আর দুর্ভাগ্যক্রমে সিনিয়র ইয়ারের পার্টি এরেঞ্জ এর মূল দায়িত্ব ছিল আমার রুম মেট প্রবাল দা র কাঁধে। আমাদের একটা রাজনীতির রুম ছিল হস্টেলে৷ রুম নং ৩৭। আমাদের কাছে ছিল ত্রাস। আগের রাতেই আমি একটুর জন্য বেঁচেছি। আমি আগের দিন ক্লাস থেকে ফিরে শুনলাম, প্রবাল দা আমাকে ৩৭ নং রুমে ডেকেছে। আমি ভগা, বিশু আর নীল কে ডেকে জানালাম। ভগা একটা ভালো কথা বললো - "আমরা এখানে পড়তে এসেছি। রাজনীতি করতে নয়। যেভাবে হোক তোকে বেরিয়ে আসতে হবে। তারপর কাল সবাই যে কোন অযুহাতে শিবেনের বাড়ি পালাবো। "
আমরা সবাই তাতে সায় দিলাম। তারপর আমি কাঁপতে কাঁপতে রুম ৩৭ এ ঢুকে দেখি প্রবাল দা একা। হাতে খেলনা বন্দুক। অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম নেকড়ের দল কই। প্রবাল দা অত্যন্ত আন্তরিক গলায় বললো - আয়, বোস। পলাশ দা র সাথে আমাদের মাঠে যে জংগল আছে ওখানে এই বন্দুকটা নিয়ে কাক মারতে গেছিলাম একটু।
একটু থেমে আবার বললো -
তুই জানিস আমাদের এখন কি ছাত্র সংগঠন আছে?

আমি বললাম ভয়ে ভয়ে - এস.এফ.আই।

দাদা - বাহ্। তাহলে বল এস.এফ.আই. এর তিন মন্ত্র কি?
হস্টেলের প্রথম দিন আমাদের পাঠশালায় দুলিয়ে দুলিয়ে নামতা মুখস্ত করানোর মত এটা পড়ানো হয়েছে। আমি এক এক করে উগরালাম -
স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর...

এইসব ভাবছি। এমন সময় আজকের ফিজিওলজি ম্যাডামের কিছু কথা কানে ঢুকলো।
" লিড ওয়ান প্লাস লিড থ্রি ইজ ইকুয়াল টু " বলে লেকচার থিয়েটারের গ্যালারিতে বসে থাকা আমাদের দিকে তাকালেন।
আমরা সবাই একসাথে বললাম - "লিড টু"।
ম্যাডাম উল্লসিত হয়ে বললেন - " সি, দিস ইজ অল ম্যাথস্। ফিজিওলজি ইজ ম্যাথেমেটিক্স "।
শীলু ফিসফিস করে বলে উঠলো - হালার বেটা এখানে ম্যাথ টা কোথায়?
নীল বললো - ফিজিওলজি যদি ম্যাথ হয়, তাহলে হোমিওপ্যাথি ও সায়েন্স।
ভগা ফিসফিস করে বলার ছেলে ছিলনা। উঠে দাঁড়ালো - ম্যাম্, আই হ্যাভ আ কোয়েশ্চেন।
ম্যাম বলতে বললেন ভগাকে।
ভগা বললো - ম্যাম, ছোট থেকে তো ম্যাথ করেছি। আপনি বললেন ফিজিওলজি ম্যাথ একই। এই আইনথোভেন এর সূত্র কিভাবে প্রমাণ করা যাবে একটু যদি অংক কষে বলে দিতেন। আমার জানতে ইচ্ছে করছে। মানে গাইটন, গ্যানং খুঁজেছি ম্যাম। সেভাবে পাইনি।
ম্যাম একটু হকচকিয়ে গেলেন। ঠিক সেই সময় ঘড়ি দেখে বললেন - এর পরের অংশ পরে পড়াবো। আজকের মত এখানেই ক্লাস শেষ। এটেন্ডেন্স টা নিয়ে নিই।
সবাই ভগার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন অপরাধ করে ফেলেছে প্রশ্নটা করে।
আমি আমার ভাবনায় ফিরে এলাম। আজ যখন "ইজ ইকুয়াল টু " বলে ম্যাম ক্লাসের তোতাপাখি গুলোর দিকে তাকিয়েছিলেন লিড টু উত্তর শোনার জন্য, ঠিক সেরকমই কাল প্রবাল দা তৃতীয় মন্ত্র শোনার জন্য তাকিয়ে ছিল আমার দিকে চাতক পাখির মত। বললেই কমরেড বলে বুকে টেনে নিত। কিন্তু আমি ছিলাম হারামি। দাদাকে বললাম ঢোক গিলে - "দাদা, আমার তৃতীয়টা বাংলায় মনে নেই, ইংরেজি তে মনে আছে। "
দাদা বললো - "বেশ তো বল না। তুই জানিস বল। "
আমি বললাম - কমিউনালিজম্।
দাদা আমার দিকে একটা স্নেহভরা হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। প্রায় পাঁচ সেকেন্ড বিশ্বাস করতে সময় নিল যে আমি সত্যিই এতটা মূর্খ।
আমি একটা ইনোসেন্ট মুখ করে তাকিয়ে রইলাম। দাদা যদি সেদিন আমাকে জানতো বুঝে ফেলতো কি উদ্দেশ্যে আমি ওটা বলেছিলাম। কিন্তু সিনিয়র জুনিয়রদের মুরগি হিসেবেই ভাবে। তাই ভাবলো এরকম মূর্খ কে নিয়ে কাজ করার থেকে না করা ভালো। বলে আমাকে যমের ও অরুচি র গোত্রের নানারকম কাঁচা খিস্তি দিয়ে বের করে দিল। নিজেকে ইউজলেস প্রমাণ করে এত আনন্দ কখনো পাইনি।

যাই হোক, কালকের কথা কাল শেষ। ক্লাস থেকে বেরিয়ে হস্টেলের বাকিদের দেখলাম দাদা রা নানারকম কাজ করাচ্ছে। তারা মুখ হাঁড়ি করে সব করছে। কেউ চরম বার খেয়ে গাছে উঠে দাদা দের দালালী ও শুরু করে দিয়েছে। আমরা কথামত চলে এলাম শিবেনের বাড়ি। আমাকে কোন দাদা কিছু জিজ্ঞেস করেনি আগেরদিনের জন্য। ভগার বাবা র নাকি কোলনোস্কোপি হবে। বিশু র আবার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। তাই বাড়ি যেতেই হবে। নীলের দিদা র বাথরুমে স্লিপ খেয়ে পা ভেঙে গেছে। এইসব বাথরুম রিলেটেড বাং মেরে শিবেনের বাড়ি এলাম। শিবেনের বাড়িতে ওর বাবা মা থাকেনা। রাতে ফিরে ঘুমিয়ে যায়। সকালে উঠে কাজে বেরিয়ে যায়। ও নিজের বাড়িতেই স্বাধীন। কনসেপ্ট টা হজম করতে আমরা পারিনি৷ আর সেখানে ভগা কিনা তার বাবার নাম হিটলার বলে ফোনে সেভ করে রেখেছে। আমাকে কিনা বাড়িতে গল্প বইটাও পড়তে দেখলে কেড়ে নিত। বিশুকে বাইরে খেলতেই যেতে দিতনা, ছেলে বাজে সঙ্গে পড়ে যাবে বলে। আর নীল উচ্চমাধ্যমিকে একটা দু নাম্বারের অংক ভুল করে এসেছিল বলে বাবার কাছে জুতোপেটা খেয়েছিল। যাই হোক, শিবেন শহরের ছেলে। হতেই পারে।
 বিকেলে ওদের পাড়ায় ফুটবল খেললাম৷ তারপর সন্ধ্যেবেলা আমরা ওর বাড়ির ছাদে শিবের প্রসাদ গ্রহণ করলাম৷ আমাদের গুরু স্বয়ং শিবেন। শিবেন খুব সিরিয়াসলি নেশাটা করে। মানে ওর একটা ছোট্ট গুহার মত ঘরে কোন খাট নেই। মাটির কাছাকাছি থাকবে বলে মাটিতে বিছানা পাতা। ঘরে অসংখ্য বই। বেশিরভাগই ফিজিক্স এর। দেখলে মনে হবে কোন ফিজিক্স হনার্সের ছাত্র। ঘরে তিন চারটে গিটার রাখা। চারিদিকে দেওয়ালে বিভিন্ন ইংরেজি ব্যান্ড এর ছবি মারা। ঘরে দু তিনটে দড়ি টাঙ্গানো তবে জামা প্যান্ট শুকোনোর জন্য নয়। কিছু লাল - নীল - সবুজ টুনি বাল্ব ঝোলানো। ও আস্তিক। কিন্তু শিব কে ভাবে এলিয়েন বিজ্ঞানী। তাই একটা শিবের মূর্তি রাখা। আর তার চারিদিকে জয়েন্টের খোল পড়ে আছে। একটা বোস এর ছোট স্পিকারে পিংক ফ্লয়েড বাজছে। আমরা সবাই আসলে শিবেনের হাতে মানুষ হতে শুরু করি। মানে এই জীবনটা ঠিক সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন নয়। মদ না খেলেও এই জীবনের এক অদ্ভুত মাদকতা আছে। পুরুলিয়ার রাঙামাটি পেরিয়ে কোন জংগলে এক পশলা বৃষ্টির পর যে জিওসমিনের সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়, সেই গন্ধের নেশা আছে।
আমাদের শিবের প্রসাদের ভাগ দিয়ে শিবেন বললো এবার ধ্যান কর সবাই গোল হয়ে বসে। একজন একজন করে কথা বলবে যা মাথায় আসছে। প্রথমে আমি বলবো। শিবেন বলে চললো সে কেন ডাক্তারি পড়তে এসেছে, তার আসার ইচ্ছে ছিলনা। কিন্তু জোর করেই একরকম সামাজিক চাপে তাকে আসতে হয়েছে। এরকম জানলে সে ইচ্ছে করে জয়েন্ট খারাপ দিত।
আলোচনা গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছিল দেখে শিবেন নিজেই বললো - তোরা কখনো কারো সাথে সেক্স করেছিস??
নীল ফট্ করে বললো - না সেক্স করিনি। কিন্তু টিউশন থেকে ফেরার সময় রোজ অটোতে একটা মেয়ের সাথে ফিরতাম। আমরা এত কাছাকাছি বসতাম অটোতে, যে ও কি কম্পানির শ্যাম্পু ইউজ করত কোনদিন, সেটাও বলতে পারবো।

বিশু এবার নীল কে থামিয়ে বললো - থাক্। সেদিন মেয়েটাকে দেখে দৌড়টা আমাদের মনে আছে। তুই চুপ কর। ভাই শিবেন, তোকে দেখলেই মনে হয় তুই কামজগতের রাজপুত্র। আমাদের কিছু টিপ্স দে ভাই। যাতে সারাজীবন ওই একটা মন্ত্র নিয়ে বাঁচতে না হয়।

শিবেন বললো - কি মন্ত্র?

নীল চেঁচিয়ে বললো - থাকিতে দক্ষিণ হস্ত, হইবোনা কারো দারস্ত।

আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
শিবেন সেই টিপিক্যাল খিক খিক করে হেসে বললো - দেখ্ ভাই মেয়ে পটানো হল একটা আর্ট। ধর্ একটা পার্টি হচ্ছে। সেখানে তোরা সবাই গেছিস। একটা দারুণ দেখতে মেয়ে সেখানে এসেছে। তুই তাকালি মেয়েটার দিকে। মেয়েটা যেই তাকাবে, অমনি চোখ সরিয়ে নিবি। আবার যেই মেয়েটা অন্যদিকে তাকাবে তুই তাকাবি মেয়েটার দিকে। এরকম কিছুক্ষণ লুকোচুরি খেলার পর একটা হাসি দিবি। হাসি মানে মোনালিসা র মত রহস্যজনক হাসি। মেয়েটা মনে মনে ভাববে,  এই ছেলেটা ঠিক করে তাকাচ্ছেও না। আবার অদ্ভুত হাসি দিচ্ছে। এর মধ্যের রহস্যটা কি। ঠিক এই সময় তুই গিয়ে বলবি এমন একটা কথা যেটাতে বোঝায় যে তুই খুব ইন্টারস্টেড আবার এতটাও নয় যে আজকেই শুতে রাজি। তোর পেছনে অনেক মেয়ে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভগা যথারীতি প্রশ্ন করে বসলো - কিন্তু একটা কথায় এটাকে কিভাবে বোঝানো সম্ভব?

শিবেন বললো - ধর তুই বললি, আমার যদি গার্লফ্রেন্ড না থাকতো, তাহলে তোমার সাথে একদিন কফি খেতে বেরোতে চাইতাম্।

বিশু বললো - হুম্ রকেট সায়েন্সই বটে। আমার দ্বারা অত পরিশ্রম হবেনা। আমার ল্যাদ লাগে।

যাই হোক্, শিবেনের পর আমার পালা এলো। আমি বললাম- " বাড়ি ছেড়ে, ৩৭ নং রুমে দাদাদের কাছে চাঁটন খেয়ে মাঝরাতে যখন প্রথম হস্টেলে রুম পেলাম সেদিন মনে হয়েছিল এখানে সাড়ে পাঁচ বছর কাটাবো কিভাবে। যে আমি কোনদিন মদ ও খাইনি সে প্রথম দিন রুমে ঢুকে দেখি পুরো ধোঁয়া। প্রবাল দা মাটিতে তার বন্ধুদের সাথে বসে তাস খেলছে আর সিগারেট, মদের গন্ধে রুম ভরে গেছে। আমি বলেই ফেলেছিলাম, এটা কি আমার রুম?
প্রবাল দা নির্বিকারে বলেছিল, বাচ্চা, আজ শুয়ে পড়। কাল ক্লাস সেরে তোমার পরীক্ষা নেওয়া হবে।

মানে খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমি যদি পালাতে চাইতাম বাবা মা বাড়ি থেকে বের করে দিত। আর এই গাঁত মারা বিদ্যে আমার আসেনা জাস্ট। মনে হয় ভুল জায়গায় চলে এসেছি। একট ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ দেখলে ভয় লাগে। রক্ত দেখলে মাথা ঘোরায়। আমি কি ডাক্তার হবো বলতো। তারপর ডারউইনের কথা মনে করি।  সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। সারা জীবন বাড়িতে থোড়াই থাকবো। এই জংগলে বাঁচতে হলে জংগলী হতে হবে। তারপর তোদের মত বন্ধু পেলাম। ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেল। মানে আগে কখনো বাড়ি ছেড়ে থাকিনি। সেটার যে এত পজিটিভ দিক আছে তোদের থেকেই শিখেছি। আর হস্টেলে একটা লাইব্রেরি আছে জানিস। এই কয়েক মাসে গুছিয়ে বই পড়ছি। অস্ত্রোভস্কি, চমস্কি যাদের নাম ও শুনিনি আগে সব শেষ ভাই। আর এক বছর থাকলে তিনটে আলমারিই শেষ করে দেবো। এখানে কেউ বারণ করারও নেই। নিজেকে খোলা ষাঁড় মনে হয়। "

সবাই হেসে উঠলো। বিশু বললো- আমি শুধু শুনবো। বলতে আমার বড় ল্যাদ লাগে। তবে ভাবছি একটু স্প্যানিশ শিখবো। মানে বাংলা হিন্দী বা ইংরেজি তে মেয়েদের সাথে কথা বলতে একটু আড়ষ্ট লাগে। তাই স্প্যানিশে যদি সেটা না লাগে। আর আজ আমি সত্যি বলবো আমার পাঞ্জাবী পরে লোকজনের কাছে বেরোতে লজ্জা লাগে।

এরপর এলো ভগা র পালা। ভগা একটু চুপ থেকে বললো - আচ্ছা তোদের কি কখনো মনে হয়েছে এই জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষাটা ইউজলেস। মানে পড়ানো হয় তো গাঁতবিদ্যা। তার যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য এন্ট্রান্সে ফিজিক্সের অংক রাখা হয় কেন? মানে ওটা যদি না থাকতো তাহলে তো আমি, শিবেন, ধীরু এই তিনজনের কেউই এই লাইনে আসতে পারতাম না।
বায়োকেমিস্ট্রিতেও ছক গাঁতানো হয়। অথচ কত কনসেপচুয়াল সাবজেক্ট। এনাটমি নামতা পড়ানোর মত পড়ানো হয়৷ যেন তোতাপাখির মত কাগজ গিলছি। আর ফিজিওলজি। বুঝে পড়। তারপর কনসেপ্ট টাই ভুলে যাও। এটা কি বালের লাইন৷ আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। আমি ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ করবো। ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করে নোবেল পাবো।

বিশু বললো - ভাই আমরাও জয়েন্ট ক্লিয়ার করে আসতে পারতাম না।

ভগা বললো - চোপ্ হারামজাদা। তুই যখন ঘুমাস না তখন ও তোর নাক থেকে গাঁত গাঁত শব্দ বেরোয়। আর নীলের কথা কি বলবো?

নীল এতক্ষণ চুপ ছিল। সে ইনসাল্ট টা গায়েও মাখলোনা। বললো - ভাই, চরম খিদে পাচ্ছে।

শিবেন বললো - দাঁড়া এই যে ডিজায়ার এসেছে তোর মনে এটাকে কন্ট্রোল কর। এখন খেয়ে নিলেই তুই সেই ভাব টা পাবিনা। এই যে ইউনিভার্স তাকে বোঝ। তোর খিদের তার কাছে একটা ছোট জোনাকির মত। তুই বল তোর কিছু বলার আছে তো।

নীল আবার বললো - ভাই খাবো ভাই, খিদে পেয়েছে চরম।

শিবেন আর কি বলবে। নীল কে বললো - ঠিক আছে খাবো চল। কিন্তু তোরা এই ভগাকে সহ্য করিস কি করে?

বিশু বললো - সিম্পল। ও ধীরুর বন্ধু।

তারপর গোটা রাত বিশু আর ভগার দাম্পত্য কলহ চলতে লাগলো। বিশু প্রমাণ করবেই যে সে ভগা গাঁতু।
আর ভগা মানবেনা। উল্টে বিশুই যে গাঁতু সেটা প্রমাণ করবে৷

যাই হোক্, তারপরের দিন ফ্রেশারস পার্টির বেইজ্জতির কথা আর নাই বা লিখলাম। আমাদের ফেস্ট ও দেখতে দেখতে কেটে গেলো। জীবনের প্রথম ফেস্ট চরম আনন্দে কাটলো। তবে ফ্রেশার্স এর পর থেকেই সিনিয়রদের ভোল পাল্টে গেল। আগের নেকড়ে আর মুরগীর সম্পর্কটা আর থাকলোনা। সিনিয়ররা আমাদের বন্ধু আর গাইডের মত হয়ে উঠলো। এখন আমার রুমমেট অরুণ দা আমাকে দেখলে ভয়ে পালায়। কারণ অরুণ দার পেটে আমি ভালো কাতুকুতু দিতে পারি। অরুণ দাও এখন আর কিছু বলতে পারেনা।
ইতিমধ্যে একদিন পাশের বাড়ির মেয়েটা ছাদে ঘুরতে এসেছিল। আমি থাকতে না পেরে একটা কাগজে-" তোমার নাম কি?" লিখে একটা ছোট ঢিলে মুড়ে মেয়েটার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছি। মেয়েটা সেটা কুড়িয়ে হেসে আমার দিকে তাকালো। তারপর ছাদ থেকে নীচে নেমে গেলো। আমি এটা কাউকেই বলিনি। এরপর আমি একদিন বাড়ি থেকে ফিরছি সন্ধ্যেবেলা, মেয়েটার সাথে আবার সেই মর্গের কাছে দেখা। বারবার মর্গের কাছেই কেন দেখা হয় সিগন্যাল বোঝা উচিত ছিল তখন। এবারে আমার মধ্যে একটু কনফিডেন্স এসে গেছিল৷ আমি সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলাম - নাম টা কি বললে না তো?

মেয়েটা এবার নির্বিকার ভাবে বললো - অপর্ণা। তোমার নাম কি?

আমি আবার চাপ খেয়ে বললাম - ধর্মদাস৷

অপর্ণা হেসে বললো - ছি৷ এটা নাম !!

- আর কি করা যাবে। নাম তো পাল্টানো যায়না। কাজ পাল্টানো যায়।

মেয়েটা শুনে মুখটা একবার বেঁকিয়ে বললো - তুমি কোন ইয়ারে পড়ো?

- ফার্স্ট ইয়ার। তুমি কোথায় পড়?

- আমিও ফার্স্ট ইয়ার। যাদবপুর।

মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে এরপর বললো - আমি একটা জিনিস চাইবো দেবে?

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। শুনেছিলাম যদু বংশের মেয়েরা চাপের হয়।
মেয়েটা একটু থেমে একটু ন্যাকামি করে বলে চললো - আসলে এত সুন্দর ওয়েদার। ঠান্ডাও লাগছে। একটু লজ্জা লাগছে কারণ প্রথমবার কথা বলেই জেনেরালি কেউ এটা চায়না। তুমি যদি না বলো কোন ব্যাপার না।

আমি জানিনা আমি কি ভাবছিলাম। কিন্তু আমার ঘাড়টা বললো - অবশ্যই।

মেয়েটা বললো - একচুয়ালি অনেক সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমাকে বাড়িতে বলছিল একটা লেপ কিনে আনতে। তুমি আমার জন্য একটা লেপ কিনে এনে বাড়িতে দিয়ে যেতে পারবে??

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এটা কিরকম হল। ভেবেছিলাম এক। চাইল আর এক।
মুখে বললাম - সিউর, সিউর। কিন্তু আমি কি লেপটা নিয়ে তোমার বাড়ি অব্দি দিয়ে আসবো?

মেয়েটা বললো - ও না না। তুমি আমার নাম্বার নাও। এখানে এসে ফোন করবে। আমি এসে লেপ টা নিয়ে নেবো।

"বাবা কেন চাকর সিনেমা " টা আমি দেখেছি। এখানে সিনটা ছিল " হিরো কেন চাকর "। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজছিল - নিয়তির একি খেলা!
সব আমার পাপের ফল। ভাবতে ভাবতে আমি রুমে এলাম। রুমের দরজা খুলেই দেখি, অরুণ দা, শীলু, ভগা, বিশু, নীল আমার দিকে একদৃষ্টিতে ক্ষুধার্ত শিকারির মত গম্ভীরভাবে চেয়ে আছে। শীলু প্রথম সেই বরফশীতল নিস্তব্ধতা ভেংগে বললো - অতক্ষণ কি কথা কইছস মাইয়াটার লগে?
অরুণ দা এতদিনে কাতুকুতু খেলার প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অরুণ দা বললো - কি আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া নাকি?

আমি কাউকে আসল ঘটনা বলতে পারলাম না। বললেই আমার প্রেসটিজ পাংচার৷ আমি বিশু আর ভগাকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। ওদেরকে খুলে বললাম৷ ওরা আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো। আমি বললাম - আমি না টা কিভাবে বলতাম?
বিশু বললো- সেটাও ঠিক৷

আমরা তিনজন লেপ বয়ে আনলাম। বিশু যেতে রাজি হল একটাই শর্তে। ওকে অপর্ণার সাথে আলাপ করিয়ে দিতে হবে৷ আমিও বললাম - কেউ যেন আসল ঘটনা আর না জানে।

অপর্ণাকে ফোন করতেই চলে এল। এসে বললো - ওর বাবা খুব রেগে গেছে আমাকে দিয়ে লেপ বইয়ে আনা করিয়েছে বলে। আমাকে ডেকেছে।

আমি চাপ খেয়ে বললাম, আমি গেলে নীল,বিশু আর ভগাকেও নিতে হবে।
মেয়েটা বললো ঠিক আছে। যেতে যেতে বিশু মেয়েটার সাথে নোংরামি শুরু করলো। হঠাৎ বলে উঠলো -" তে ভেস্ মুই হারমোসো।"
অপর্ণা তাকালো। বিশু বললো - "এটা স্প্যানিশে, তোমাকে সুন্দর লাগছে। "
অপর্ণা "ও" বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

(To be continued)
(Share the story with your friends if you like it.. Follow the blog to stay connected) 

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...