Monday, March 2, 2020

নীলরতনের পাঁচ রতন | দ্বিতীয় পর্ব | প্রথম সবকিছু |

সেদিন পূর্ণিমার রাত ছিল। পার্ট পরীক্ষায় একটু বেশি নাম্বার পাওয়ার অপরাধে আমার সাথে বিশুকে আলাদা করে দিয়ে বাকিরা একসাথে পড়তে বসেছে। আমরা জানি এই ছেলেমানুষী রাগটা একবেলার খুব বেশি হলে।  শিলু সবচেয়ে বেশি পেয়েছে। ও সবাইকে যেচে জিজ্ঞেস করছে - কত পাইলা মামা?
যাই হোক, আমি ঠিক করলাম আমি আর বাকিদের সাথে না পড়ে শিলুর সাথেই পড়বো। আমি আর বিশু এনেক্স বিল্ডিং এর ছ'তলার ছাদে বসেছিলাম। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিশুকে বলছিলাম - ভাই চাঁদটাকে দেখ্।

বিশু - আর দেখে কি হবে? তুই জানিস, ওই যে গান্ডু মালটা.. প্রকাশ... শুয়োরের মত মুখ। ওরও গার্লফ্রেন্ড আছে। আর তোর আর আমার কি আছে? কয়েক নাম্বার বেশি?

আমি - সত্যি ভাই, আমরা একেবারেই অকর্মণ্য। জীবনে কিছুই হবেনা। সেই বাপ গুলো হস্টেলে ছেড়ে দিয়ে গেছে ট্যাংকির সাথে, খোঁজ ও নেয়না। নিজেকে কেমন খোলা ষাঁড় মনে হচ্ছে।

শিলু কোথা থেকে ছাদে এসে আমাদের কথা শুনতে পেয়ে উত্তর দিল - এটা কি কইলা। জীবনকে পজিটিভলি নিতে লাগবা ৷ মেয়েরা আইসলে পোষা প্রাণী পছন্দ কইরে। মাইনুষ না।

বিশু - ঠিকই। উঠতে বসলে উঠো। বসতে বললে বসো।  দুষ্ট গোরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো। চল ধীরু (আমি), সিগারেট খাবো।

আমি - ভাই , আমি খাইনা।

বিশু - আরে বাঁড়া, খাইনা কি। আমিও তো খাইনা। প্রেমও তো করিস না। তাবলে কি সারা জীবন করবিনা৷ সবকিছুরই প্রথম হয় একদিন। চল্। আজ প্রথম সিগারেট খাবো। গার্লফ্রেন্ড ও হয়ে যাবে।

শিলু রাজি হলনা। আমি আর বিশু সিগারেট খাবো বলে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখি আমার সিনিয়ররা লোলুপ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সিনিয়রদের কাছে আমরা হলাম মুরগী আর সিনিয়র রা হল ফ্রাস্ট্রেটেড ক্ষুধার্ত নেকড়ে।
এখানে সিগারেট খেলে আমাদের খবর আছে। আমার রুমমেট প্রবাল দা সিগারেট খেতো। ঠিক করলাম রুমে কোন সিগারেট থাকলে ওটাই দুজন মিলে দরজা বন্ধ করে মেরে দেবো। যেমন কথা তেমন কাজ। দরজা বন্ধ করে দাদার সিগারেট টা সুন্দর করে মেরে দিলাম। শুরুতে একটু কাশি হল বটে। কিন্তু খেয়ে মাথাটা দুজনেরই অল্প অল্প ঘোরাচ্ছিল।
তারপর ঠিক করলাম আমি, বিশু, ভগা আর নীল মিলে প্রথম কোলকাতায় সিনেমা দেখবো। আমরা চারজনেই মফস্বল থেকে আসা ছেলে। ফলে কোলকাতায় প্রথম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা ছিল খুব উত্তেজনাপূর্ণ। ঘটনা ঘটলো ফেরার সময়। এলিট সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে চারজন এস.এন.ব্যানার্জী রোডে দাঁড়িয়ে আছি ফেরার বাস ধরবো বলে। আমি অনেক্ষণ থেকেই লক্ষ্য করছিলাম সব বাস, ট্যাক্সি ধর্মতলার দিকে যাচ্ছে। উল্টোদিক থেকে কেউ আসছেনা। যারা এটা পড়ে অবাক হচ্ছেন তাদের বলি, তখন সবে মোবাইল এসেছে। মোবাইলে গুগল ম্যাপ বা নেট কিছুই নেই। আমাদের কোলকাতা সম্পর্কে ধারণা ছিল শূন্য। আর মফস্বল থেকে এসে ওয়ান ওয়ে রোড সম্পর্কে ধারণা না থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি বললাম সবাইকে - ভাই আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

নীল বললো - ভাই, চাপ ই নাই। এত ধৈর্য কম কেন। একটু অপেক্ষা কর। ঠিক কিছু না কিছু চলে আসবে। নাহলে হেঁটে চলে যাবো।

বিশু বললো - না বাঁড়া আমি হেঁটে যাবোনা। আমার ল্যাদ লাগে।
এরকম ভাবে তিরিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর আমি আর থাকতে না পেরে শিবেন কে ফোন করলাম সমস্যাটা জানিয়ে। শিবেন বললো - আরে ওটা ওয়ান ওয়ে রোড। তোরা কাউকে জিজ্ঞেস করে লেনিন সরণীতে চলে যা। বাস পেয়ে যাবি।
আমি বললাম - ভাই তুই তো ডন। কোলকাতার সব রাস্তা তোর মুখস্ত, বল।
শিবেন বার খেয়ে গেল। বললো - ভাই, আমি না রোজ সকালে বেহালা থেকে ময়দান জগিং করতে করতে আসি। তারপর বাস ধরে ফিরি।
তারপর এরকম অনেক শিবেনের কাহিনী শোনার পর আমরা বাস ধরে ফিরলাম। হোস্টেল ঢুকছি। মর্গের কাছে একটা নিরিবিলি জায়গায় কোণটা ঘুরবো, এমন সময় মুখোমুখি দেখি সেই মেয়েটা। মানে আমার জানালা দিয়ে যাকে দেখা যায়। আমরা চারজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের দেখে মেয়েটাও হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
বিশুকে ফিসফিস করে বললাম - কিরে গিয়ে কথা বল৷ একদম নির্জন তো। তুই না বিশাল গার্লফ্রেন্ড চাস৷

বিশু -- আজ আমার দিনটা শুভ নয়। আর ল্যাদ লাগছে। তুই বল।

আমি -- আমি বলতেই পারি। কিন্তু যেহেতু শীলু বুক করে রেখেছে, তাই বলবোনা। আমি বন্ধুদের কথা ভাবি। ভগা, তুই না শাহুরুখ খানের ভক্ত। যা।

ভগা -- ভাই, চুপ কর। মেয়েটা শুনতে পেলে কি ভাববে।

আমি -- শালা, এমনিতে বিশাল ডন। আর মেয়ে সামনে দেখতেই হাওয়া বেরিয়ে গেল। নীল তুই যা না।

নীল আমাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় মেয়েটা হেসে বললো - কিছু বলবে?
আমরা এর ওর দিকে মুখ চাওয়াচায়ি করে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নীল দেখলাম এক ছুট্টে হস্টেলে ঢুকে গেল।
আমি কি করবো বুঝতে না পেরে মেয়েটাকে খাবি খেতে খেতে বললাম - হেলো, হাউ আর ইউ। আই এম ফাইন। থ্যাংক ইউ।
বলে আমিও দৌড় লাগালাম। আমার পেছনে দেখলাম বিশু আর ভগা ছুটে ছুটে আসছে। বিশু বলছে - ভাই ছুটিসনা। আমি ছুটতে পারছিনা। ল্যাদ লাগছে।

চাপ খাওয়ার কথা ছিল মেয়েটার। খেলাম আমরা। চারজন ছিলাম। হস্টেল এসে আমরা ঠিক করলাম এই কথা যেন পাঁচকান না হয়। কারণ তাহলে আমাদের মান ইজ্জত থাকবেনা। যাই হোক, সেই ছিল আমার কোন মেয়ের সাথে মুখোমুখি প্রথম ইন্টার‍্যাকশন। মনে মনে বুঝলাম আমাদের মত ছেলেরা শুধু ঝাড়ি মারতেই পারে, মুখোমুখি কথা বলার মত পরিস্থিতি এলেই আমাদের মধ্যবিত্ত সত্ত্বা বলে - ভাগ্ ডি কে বোস।
 ইতিমধ্যে আমাদের হস্টেলে আরো একটি ছেলেকে দেখে আমাদের খুব জ্বলতো। তার নাম নিরভ্র।
ছেলেটি এমনিতে ভালো। কিন্তু তার দোষ হল সে প্রচুর পড়াশোনা করে।  আর ভগা র ওর উপর প্রচুর ক্ষার। ব্যাপারটা খুলেই বলি তাহলে। একদিন কি হয়েছে, আমি রাতে খেয়ে এসে বাথরুমে গিয়ে দেখি ভগা জিভ বের করে জিভে সাবান ঘষছে। আমি তো দেখে থ। আমি বলি- কি রে কি হল।
ভগা বলছে- আর বলিস না এত ইনফেকশন চারিদিকে। এই যে মেসের জঘন্য খাবার টা খেলাম তাতে যে কত এন্টামিবা আছে তার ঠিক আছে, তাই জিভকে স্টেরিলাইজ করছি।

ভগা র এটা ছাড়াও আরো অনেক অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের উপসর্গ ছিল। ও সিগারেট খেয়ে ক্লোরহেক্সিডিন মাউথওয়াশ এ কুলকুচি করতো। দরজায় ছিটিকিনি আটকালে হাত দিয়ে না আটকে লাঠি দিয়ে করতো৷ অন্যের হাতের ইনফেকশন যাতে না চলে আসে। একদিন ক্যান্টিনে সবাই খাচ্ছি৷ ভগা সিগারেট খেয়ে ওরকম মাউথওয়াশ সবার সামনে বের করে কুলকুচি করছিল। নিরভ্র সেটা নিয়ে সবার সামনে কি খিল্লি করলো। আমরাও তো ভালো ছেলে নই। আমরাও ওর সাথে খিল্লি করলাম। কিন্তু বুঝিনি সেটা ওর খারাপ লাগবে। ভগা আমাকে মাঝরাতে সেদিন ডেকে বললো - আমি জানি আমার কিছু কাজে আমাকে পাগল লাগে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমাকে এটা করতেই হয়।

আমি বুঝলাম ওর খারাপ লেগেছে। নিরভ্র র থেকে ভগার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই আমি, বিশু আর নীল মিলে প্ল্যান করলাম নিরভ্র কে নিয়ে একটা কান্ড করতে হবে। কাজটা সহজ করে দিল শীলু। শীলুর কাছে বিশ্বের যত আননোন নাম্বারের সিম ছিল। তখন আধার কার্ড লিংক টিংক এর গল্প ছিলনা। আর নীল খবর দিল যে নিরভ্র র ক্রাশ হল আমাদের ব্যাচের একটা মেয়ে সংগীতা। ইতনা হি কাফি হ্যায়। মেয়েদের সাথে সরাসরি কথা বলার ক্ষমতা হয়তো তখন ছিলনা। কিন্তু আননোন নাম্বার থেকে মেয়ে সেজে মেসেজ তো করা যায়। শুরু হল মেসেজে নিরভ্রর সাথে চরম প্রেমালাপ। একদিন নিরভ্র সকালে লিখে পাঠালো - "আজ ক্লাসে তোমার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকবো। দেখবো তুমি ফিরে তাকাও কিনা। "
সেদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি নিরভ্র ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সংগীতার দিকে। সংগীতা জানেও না কেউ তার দিকে এরকম তাকিয়ে আছে। ভগাকে সব বললাম। ভগা তো বিশাল মজা নিল। সেই ছিল আমাদের একসাথে করা প্রথম শয়তানি। তবে আজ যখন ভাবি সেইসব প্রথম সবকিছুর কথা তখন মনে হয় - এই কাজ টা করা ঠিক হয়নি।
মেসেজ বন্ধ করার পর যখন নিরভ্র র রুমে গেছিলাম তখন দেখি সে পড়া বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে বসে আছে।
ভগা বললো - বুঝলি কাজটা ঠিক হয়নি। যাই হোক, প্রথম সেমিস্টার আসছে। আমাদের পড়তে হবে।

নীল বললো - ভাই, কেকেআর এর খেলা দেখতে যাবি?

ভগা - না ভাই, পড়তে হবে।

নীল - ভাই কেকেআর এর জার্সি শিয়ালদা তে একশো টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। পেছনে আবার লেখা "খান"।

ভগা - চল, দেখে আসি। তবে স্টেডিয়ামে দেখতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। সিনেমা হলে গিয়ে দেখবো। বিশু যাবি?

বিশু - না ভাই, ল্যাদ খাবো।

ভগা - তুই গাঁড় মারা। আমরা তিন খান যাবো কেকেআর এর ম্যাচ দেখতে। তারপর পড়তে বসবো।

( To be continued)
( Please follow the blog if you like my work and share among your friends)
( এই সিরিজের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক)

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...