Monday, June 19, 2017

The Last Injection

- আছে ?
- কত র মাল চাই ?
- ৩৫
গাঁজার পুরিয়া টা নিয়ে ট্রেনে উঠলেন যুবকটি। মাঝারি উচ্চতার, উস্কো খুস্কো চুল, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, পরনে সাদা পাজামা- ছেঁড়া কালো কুর্তা। ঝোলা ব্যাগে হাতড়ে দেখলেন। ইনসুলিন আর সিরিঞ্জটা ঠিক ঠাক আছে কিনা। উপায়টা আজকেই মাথায় এল আসলে। মাথায় এলো যখন করেই ফেলা যাক। আর ভাবনা চিন্তা করে লাভ নেই। অনেকদিন ধরে ঝুলছিল চিন্তাটা। আজ খুব সহজ সমাধান বেরোলো। একটা হোটেলে যাবে। সেখানে গাঁজা খাওয়া হবে। তারপর কিছু শেষ লেখা। এরপর বেশ দামী কলগার্ল আগে থেকে অর্ডার দেওয়া আছে। হোটেলের দালালকে বলেছে - একদম ফ্রেস মাল হলে ভালো হয়।
অনেক ন্যায় করল। যাওয়ার দিন একদম সব কিছু অন্যায় করে যেতে চায়। তাই টিকিট ও কাটেনি ট্রেনের । সবাইকে টাকায় ভরিয়ে দেবে কথা দিয়েছে। ব্যাংকে যা আছে শেষ কিছু। সব কিছু হলে মালকে বিদায় করে একটা ইনসুলিনের ইঞ্জেকশন চামড়া তে না, শিরাতে । সুগার ফল করবে, পটাসিয়াম ফল করবে দুমদাম। আর তার জীবন ও। আগে চরিত্র নীচে নামাতে চায়, তারপর পটাসিয়াম। তারপর আসবে সেই মুহূর্ত - হোটেলের এক রুমে কার্ডিয়াক আরেস্ট, ব্রেন ডেথ। সুইসাইড নোটে লেখা থাকবে, 'আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।'
দেখতে দেখতে হোটেলের সেই রাত এল। হোটেলের ম্যানেজার ফোন করে বললেন - স্যার মিস বিজলী আপনার রুমে যাচ্ছে। আপনি ওর সাথেই ওর রেট ফিক্স করে নিন। আর আমাদেরকে ভুলবেন না যেন স্যার। হে হে।

দরজাটা খুলতেই অবাক হতে হল। বছর বাইশ-তেইশের একটি ফুটফুটে মেয়ে, দেখে তো শিক্ষিত মনে হয়। কি করে এল এই লাইনে। চোখে মুখে একটা চাপা উদ্বেগ ঢাকার অসহায় চেষ্টা। নাহলে ক্লায়েন্ট বিরক্ত হতে পারেন। দরজা লাগিয়ে সামনের চেয়ারে এসে বসলো সে। পা দুটো ঢাকা থাকলেও সে দুটো যে কাঁপছে নজর এড়ালো না।

হঠাৎ বলে উঠলো মেয়েটি - নিন বাবু শুরু করুন। আমি খুলবো না আপনি ?

শুনে নিজের অট্টহাসি চাপতে পারলেন না বাবু। বাবু বললেন - এই লাইনে কতদিন ?

মেয়েটি উঠে এসে স্মার্টলি বাবুকে বিছানায় ঠেলে দিয়ে বললে - সারা রাত কি এরকম মুখেই গোয়েন্দাগিরি করবেন ? মাল্লু কিন্তু কমাতে পারবেন না। মানি হ্যায় তো হানি হ্যায়।

বাবু - তা তুমি কিসের হিসেবে টাকা নাও। ওয়ান শট, টু শট নাকি ঘন্টায় নাকি রাতের হিসেবে।

- ওয়ান শট, টু শট টা কি ?

এবার আবার হেসে উঠলেন বাবু। বললেন
- বুঝলাম নতুন। কারণটা জানতে পারি। আর তোমার নামও নিশ্চয়ই বিজলী নয়।

- এসবে আপনার জেনে কি হবে। আপনার যা দরকার পাবেন।

- তুমি যদি বলো আমিও বলবো। চিন্তা নেই তোমার টাকা তুমি পাবে। আমরা দুজনেই তো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।

- কি বলতে চান ?

- তুমি এসেছো শরীর বিক্রি করতে, আমি এসেছি প্রাণ বিক্রি করতে। এই যে সিরিঞ্জ।

- কিন্তু কেন ? আপনার তো টাকার অভাব নেই মনে হয়।

- আমার ও একি প্রশ্ন। কেন ? এই কবিতা টা শুনেছ? -
'শরীরের ভেতরও একটা জানালা আছে,
পর্দার ওপারে মন,
দুর্গন্ধে ঢাকা পড়ে যায় কেন তোমার জীবন ? '
ধুস, কিসব কাকে বলছি।

বিজলী -
' সূর্যের মত হতেম যদি,
সব কালো নির্বাক হয়ে যেত,
অসীমে বিলীন।
রক্তাক্ত বুকের 'পরে সময়ের মরা স্রোত,
বিকলাঙ্গ নদীতীর সেখানেও ছাপ রেখে যায়,
তবু স্মৃতিটুকু রয়ে যাক,
আমি হই আকাশ মলাট জুড়ে-
আলপিন তারা,
অজাত জন্মে হই আমি দিশেহারা।'
- আপনি এই কবিতা জানলেন কি করে ?
- আমি বাংলা হনার্সের ছাত্রী ছিলাম। অবচেতন চ্যাটার্জী আমার আধুনিক কবিদের মধ্যে খুব প্রিয় কবি। আমি ওনার সব লেখার ফ্যান। আমার বাবা- মা এক দুর্ঘটনায় মারা যান। আমার ভাইএর অসুখ। টাকা দরকার খুব তাড়াতাড়ি। আমি অনেক জায়গায় চাকরির খোঁজ করেছি। ফার্স্ট ক্লাস নাম্বার আছে। ভালোবেসে বাংলা পড়েছি। কিন্তু তবু চাকরি পেলাম না। সোজা পথ অনেক হল। এবার তাই আজ এই পথে নামলাম। আমি নতুন হতে পারি, কিন্তু আপনাকে সব ভাবে সন্তুষ্ট করতে পারবো আমার বিশ্বাস। শুধু আপনি আমার ফিজ টা কুড়ি হাজার দিয়ে যাবেন। টাকাটা খু-খুব দরকার আমার। যদি বেশি বলে থাকি এক রাতের জন্য তাহলে আর এক রাত আপনি যেখানে বলবেন।
বলে মাথাটা নিচু করলো। আবার বলতে শুরু করলো।
অবচেতন চ্যাটার্জীর প্রত্যেকটা লেখা পড়ে আমি কেঁদেছি। এত দরদ নিয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে লেখেন। ওনার সাথে একবার দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হয়ে ওঠেনি । মানুষটার হৃদয়খানি অনেক বড়। একবার দেখা করে বলতাম আমার অবস্থা। উনি নিশ্চয়ই আমায় সাহায্য করতেন। কিন্তু আপনি কিসব বলছেন মরতে চান। দেখুন আমি কোন ঝামেলায় পড়তে চাইনা।
- যদি বলি আমি অবচেতন। আমার হৃদয়ে আর কোন প্রেম নেই। শুধু প্রহসন আছে। তাই কবিতা বেরোচ্ছেনা। তাই মরতে চাই। মরার আগের রাতে একটু মজা করে যেতে চাই।
মেয়েটি অবাক হয়ে তাকালো। একটু ভেবে মেয়েটি হেসে বললো - আপনি হতে পারেন না। আমার বিশ্বাস। সমাজ বিক্রি হয়ে গেলেও উনি হবেন না। যে ওরকম লিখতে পারে তার মত সত্যিকারের মানুষ আর যাই হোক এখানে আসবেন না।
বাবু এবার হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন
- ধরে ফেললেন দেখছি। মজা করছিলাম। কি বলবো বলুন জীবনে বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা। তাই। আচ্ছা আপনি তো কাউকে বিয়ে করে নিতে পারতেন। আপনার স্বামী সব দেখতো।

- আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তার সাথে কয়েকবার বাইরে দেখাও করেছি। সে আমায় চুমু খেয়ে বলেছে আমায় ভালোবাসে। বাবা-মা মারা যাওয়াতে পণের টাকা দিতে পারতাম না, ভেংগে যায়। ভালোবাসা ভেংগে যায়। অনেক খুঁজে যখন চাকরিও পেলাম না। ভাবলাম সমাজটাই তো বেশ্যা। আমিও নাহলে কয়েকটা রাতের জন্য হলাম।

- বুঝলাম, গাঁজা খাবেন ?

- আমাকে হঠাত আপনি করে কথা বলছেন কেন ?

- আপনি যেটা ডিজার্ভ করেন তাই করছি। গাঁজা ?

- আপনি তো ক্লায়েন্ট। আপনি যা বলবেন করবো। শুধু প্রাণে মেরে ফেলবেন না। গাঁজা আগে কখনো খাইনি। তবে আপনি বললে খাবো। আমার দরকারও। শুনেছি গাঁজা খেলে হুঁশ থাকেনা সমাজের।
গাঁজা খেয়ে দুজনে বসলো জানালার ধারে। এসি অফ করে জানালাটা খুলে দিলেন বাবু। দুজনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারা রাও আজ বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে যেন কারো শেষ ইঞ্জেকশনের অপেক্ষায়। দুজোড়া চোখের তারায় তারাদের অভিব্যক্তি হৃদয়ের রক্তস্রোতে হিন্দোল তুলছিল। বৃষ্টি নামল।

বাবু বললেন
- আমি আপনাকে স্পর্শ করবোনা। কিন্তু আমি আপনাকে যা বলবো আপনাকে শুনতে হবে। আপনার টাকা আমি দিয়ে দেবো চিন্তা নেই।

- বলুন, উত্তর এল।

মেয়েটির মাথা ঝিমিয়ে এসেছে। দূরে কোথাও একটা হাতুড়ি ঠোকার আওয়াজ ও এখন তার কানে এসে ঢুকছে। বৃষ্টি তার কানে সেতার বাজাচ্ছে। এমন সময় বাবু শুরু করলেন।

- ওই দূরে দেখতে পাচ্ছেন, একটা ল্যাম্পপোস্ট আর তার ছায়াটা কিরকম বৃষ্টির জলে ভিজছে দেখুন। আপনি অনুভব করুন আপনি ওই ছায়াটা। আপনি ও মিশে গেছেন বৃষ্টিতে। আপনি অনুভব করুন আপনি সেই বৃষ্টির ফোঁটা। অনেক উপরে অনেক্ষণ আপনাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে রেখেছিল। তারপর আর ধরে রাখতে পারেনি রতিতৃপ্ত মেঘ। আপনি ঝরে পড়ছেন পৃথিবীর শরীরে।
বাবু একটু থেমে হঠাত উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন - দেখুন কত জোরে বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টি আজ পাগল হয়ে গেছে। আমিও পাগল হয়ে গেছি। আমার ছটা ইন্দ্রিয় গিটারের ছটা তারের মত বৃষ্টির সুরে বাজতে চাইছে। আমি কবিতা লিখছি আবার -
যেভাবে বুড়ো বটের ঝুরি ধরে সন্ধ্যে নামে,
রংগের আদর মাখে ভেজা পাতা,
সেভাবে আমার সামনে তুমি এলে,
আবেগের হাওয়া মেখে,
পেন ধরো তুমি,
ফুটে ওঠো না-লেখা কবিতা।
হাঁপাতে লাগলেন উত্তেজনায় বাবু। মাথা ধরে বশে পড়লেন। হঠাত বাবুর চোখ ভিজে এল। ধরা ধরা গলায় সামনের বাড়িটার দিকে আঙ্গুল তুলে বলে যেতে লাগলেন।
'সমাজ তুমিই আসল বেশ্যা, ফাঁপা,
তাই যারা আজও সত্যি হয়ে আছে,
পড়ছে ধুলোয় চাপা।'
থর থর করে কাঁপতে লাগলেন উত্তেজনায় । একজন হাত-পা কাটা মানুষ হঠাত তার হাত পা ফিরে পেয়েছে যেন। সে উত্তেজনায় কাঁপছে। যে এতক্ষণ অন্য একজন ছিল। অজস্র যন্ত্রণা সেই বাবুর চোখে মুখে ঠিকরে বেরোচ্ছে। তাকে যেন কোন সাপ কামড়েছে। বিষের জ্বালায় ছটপট করছে। হঠাত কাঁদতে লাগলো, যেন সে একজন বিবাহযোগ্যা যুবতী, তাকে কেউ বিয়ের রাতে ধর্ষণ করেছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে মেয়েটির। মানুষটা কি পাগল ? চোখ বুজে এল ঘুমে। বিছানায় মাথা এলিয়ে দিলো সে।
'আপনি কে ? ' বলে ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটি। অর্জুনের সহস্র তীর অজেয় ভীষ্মকে ধরাশায়ী করেছিল। আজ মেয়েটির একটি শেষ প্রশ্ন ইনসুলিনের থেকেও মারাত্মক গভীরতায় বাবুকে বিদ্ধ করলেন। কিন্তু উলটো পথে। সেই কবিতা ফিরে এসেছে অবচেতনের । অবচেতন কে?

++++
এতটা পড়ে থামলে থামলেন অবচেতন। লাইভ টিভি শো চলছে। সঞ্চালক ও উপস্থিত সকলে হাততালি দিয়ে উঠলেন। সঞ্চালক প্রশ্ন করলেন
- আপনার গল্পের চরিত্র, কথা সব এত জীবন্ত। এগুলো কি সত্যি ? আমরা সবাই জানতে চাই।
হাল্কা হেসে অবচেতন বললেন,
- সত্যি হলে মেয়েটি নিশ্চয়ই আমার এই লাইভ ইন্টারভিউ দেখছে। মেয়েটি যেন একবার আমার সাথে যোগাযোগ করে। দরকার ছিল। সি ওয়াজ মাই লাস্ট ইঞ্জেকশন।

Buddha, the enlightened

সকাল হবে হবে করছে , প্লার্টফর্মে ট্রেন থামলো, একটি ছেলে উঠলো ট্রেনে ছুটে এসে। একদম ভোরের প্রথম ট্রেন, ফাঁকা ফাঁকা। একটা কোণে গিয়ে বসে পড়ল সিটে। তার পাশে আর সামনে পেছনে আরো পাঁচজন এসে বসলো। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। হঠাত সাদা কাপড় পড়ে এক মুণ্ডিতমস্তক যুবক লাঠি হাতে উঠল ট্রেনে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ধীরপায়ে এসে সে ওই ছয়জনের পাশেই বসলো।
ট্রেন চলতে লাগল। সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চটিপায়ে ওই সাদা কাপড়ের লোকটির দিকে আড় চোখে দেখছে। শীর্ণকায় শরীর, অতি সাধারণ এক মুখ, চোখ দুটি কোটরস্থ, উজ্জ্বল এবং শান্ত । শারীরী ভাষা এতটাই অন্যরকম শান্ত যে বয়স কম হলেও সম্মান করতে মন জাগে।
কৌতুহল চাপতে না পেরে একজন প্রৌঢ় বলে ফেললো - কেউ মারা গিয়েছে নাকি ?
সাদা কাপড়ের লোকটি উত্তর দিল - হ্যাঁ, অনেকে। আমার সব ঋণাত্মকতা মারা গিয়েছে।
এরকম একটা অদ্ভুত উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তা খুব কৌতুক অনুভব করলো।
উত্তর দিল - তা আপনি কি সাধু ?
উত্তর এল - আমি এমন একজন যে সর্বোচ্চ জ্ঞান লাভ করেছি । পরম সত্যকে জেনেছি। আর সেটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এসেছি। সংসারে মানুষের দু:খ কষ্টের উপশম করতে এসেছি। আমি একজন বুদ্ধ। সাধুও বললে আপত্তি নেই।
'তাই নাকি' এবার প্রথম সেই দাঁড়িওয়ালা যুবক ব্যংগ করে উঠলো।
'তা সাধু আপনি পারবেন আমার সমস্যার সমাধান করতে ? '
উত্তর এল, 'বলুন'
যুবক শুরু করলো।
' আমাকে সবাই কেমো বলেই জানে, হসপিটালে ডাক্তার ছিলাম ক্যান্সার বিভাগে। তারপর আমার একটি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়। প্রচুর কথা হত। মেয়েটির সংগে আমার একটি ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়।তারপর জানতে পারি ও আমাকে প্রতারণা করেছে। আমাকে না জানিয়েই অন্য একটি ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায়। রাগে অপমানে আমি ছটপট করতে থাকি। আমি সেই ছেলেটিকে একদিন আলাদা করে নিয়ে বসি। ছেলেটি আজেবাজে বলায় তাকে খুন করে দিই। আমার জেল হয়ে যায়। জেলে যাওয়ায় আমি চাকরি থেকে বরখাস্ত হই। জেলে ভালো ব্যবহারের জন্য আমি আজ ছাড়া পেয়েছি।কিন্তু রোজ রাতে ছটপট করতাম ছেলেটাকে খুন করেও আমার শান্তি হয়নি। শুনেছি ও আবার বিয়ে করেছে অন্য একজনকে। তাকেও খুন করবো যাচ্ছি। কিন্তু জানিনা শান্তি পাবো কিনা। এর সমাধান কোথায় বলুন। মেয়েটাকে খুন করলে কি শান্তি হবে নাকি নিজেকে ? '
বুদ্ধ স্মিত হেসে তাকালেন তার দিকে। কি অদ্ভুত শান্ত সেই হাসি। একটা সুনামিও স্থির হয়ে যেতে পারে সেই হাসি চোখের রেটিনায় চুম্বন করলে।
- তুমি ওকে ভালোবাসতে ?
- হ্যাঁ।
- কতটা ?
- অনেক। এখন ঘৃণা করি।
- আচ্ছা তুমি কোন ফুল পছন্দ কর ?
- গোলাপ।
- গোলাপ দেখলেই মনে হয় তুলে ওকে দিতে ?
- হ্যাঁ মনে হয়।
- আচ্ছা তুমি কখনো শরতের সকালে শিউলি গাছের তলায় গিয়ে প্রাণ খুলে শ্বাস নিয়েছ ?
- হ্যাঁ নিয়েছি।
- কেমন লেগেছে ?
- খুব ভালো।
- তোমার মনে হয়েছে গাছের সব শিউলি ফুলগুলো তুলে ওর হাতে দিতে ?
- না শিউলির ব্যাপার টা আলাদা। ওকে বরং গাছের তলা থেকে দাঁড়িয়ে আমার মত প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে বলবো।
- শোন তুমি গোলাপ কে পছন্দ কর আর শিউলিকে ভালোবাসো।
- তার মানে কি বলতে চান ?
- ভেবে দেখো, যে তোমার কোনদিন ছিলনা, তোমার আড়ালে অন্যের সাথে সম্পর্ক করেছে সেই ফুলকে ভালোবেসে থাকলে তাকে যে গাছে মানায় সেখানেই থাকতে দিয়ে হাসিমুখে সরে এসো।
- কিন্তু এভাবে চলে যেতে দেওয়া যায় না যাকে ভালোবাসা যায়।
- হ্যাঁ যায় এটাই ভালোবাসা। ওকে ছেড়ে দাও। ফিরে না এলে ও তোমার ছিলোনা কোনদিন। শেষ দিনে কতটা তুমি ভালবেসেছো মানুষকে, কতটা নম্রভাবে জীবন কাটিয়েছ, কতটা ভালোভাবে কাউকে যেতে দিয়েছ যে তোমার জন্য নয়, এটাই শুধু মাথায় থাকবে।
অনেক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাত ধরা গলায় প্রথম যুবক বললো
- কিন্তু আম-মি যে মানুষ খুন করেছি, অনেক বাজে কাজ করেছি।
- যত কঠিন তোমার অতীত হোক, তুমি আবার নতুন শুরু করতে পারো।
- আমি কিভাবে শান্তি পেতে পাবো। ও আমাকে শান্তি দিত।
- ও নয়, শান্তি একমাত্র তুমিই নিজেকে দিতে পারো। বাইরের কেউ নয়।
- কিন্তু সাধু আমি অনেক খারাপ কাজ করেছি। ও আমায় ছেড়ে যাওয়ার সময়, আমি মেয়েদের প্রতি ঘৃণা থেকে অনেকের সাথে ফ্লার্ট করতাম। এর মধ্যে অনেকে নিশ্চয়ই ভালো ছিল। ওদের কে বন্ধু বলতাম। বেশি কিছু দাবী করলে ঝেড়ে দিতাম। আমাকে তো ওরা খুব ঘৃণা করে এখন।
- বেশ তো। সবার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিও। এতে যদি শান্তি পাও। কেউ তোমার সাথে খারাপ কিছু করলে তাকেও ক্ষমা করে দিও। কখনো দেখোনি সকালের আলো কিভাবে জানালার ফাঁক চিরে প্রবেশ করে। ঠিক সেভাবে আঘাত পেলে সেই স্থান দিয়ে আলো প্রবেশ করে যদি তুমি চাও।
- আপনি কি করে ক্ষমা করেন যারা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করে ?
- হয়তো তারা ভুল করে, হয়তো তারা আমায় ভুল বুঝে করে। যাই করুক, আমি জানিনা তারা কি পরিস্থিতিতে করে। সবাই যে যার পরিস্থিতির স্বীকার। ক্ষমা করতে গেলে বুঝতে শিখতে হবে। বুঝতে গেলে ক্ষমা করতে জানতে হবে। তুমি জানোনা তার পরিস্থিতিতে তুমি কি করতে। তার মধ্যেও রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ সব আছে। রাগ মানুষের বুদ্ধিনাশ করে। সে সেটাই ভাবে যেটা সেই সময় তার পরিস্থিতি আর অভিজ্ঞতা ভাবতে বাধ্য করে। কাউকে ক্ষমা না করলে শান্তি পাবেনা। একমাত্র আলো পারে অন্ধকার কে দূর করতে। অন্ধকার পারেনা। তাই কাউকে সহজে বিচার কোরোনা। তুমি কেউ নও বিচার করার।
- রাগ কে বশ করার উপায় কি ?
- তার ক্ষতি করা খুব কঠিন যে কিছুই চায়না, শুধু ভালোবাসতে জানে। পৃথিবীর সব যুদ্ধ জয় করার থেকে নিজেকে জয় করা বড় জয়। মানুষের মন নিজেই নিজের সব থেকে বড় শত্রু আর সব থেকে বড় বন্ধু । তুমি কে পুরোটাই নির্ভর করছে তুমি কি ভাবছ তার উপর। নিজেকে জয় করতে পারলেই তুমি বুদ্ধ। প্রকৃত
জ্ঞানী। অনেক জন্মের অনেক ধাক্কা, যন্ত্রণা অভিজ্ঞতা আর সাধনা মানুষকে সেই জায়গায় নিয়ে যায়। আমি বলবো তুমি নিজেই সেই পথ খোঁজো । প্রকৃত জ্ঞানের পথ। হাজারটা বড় কথার থেকে একটু সাধনা সেই পথকে ত্বরাণ্বিত করে।
- সবাই যদি প্রকৃত জ্ঞানী হয়, তাহলে তো আর কেউ সংসার করবে না ।
- কেন সেটা হবে। বরং লোকে আরো শান্তিতে সংসার করবে।
- কেন ? আপনার পথ তো সন্ন্যাসের পথ।
- সংসারে জ্ঞানীর মত বেঁচে থাকাও তো একরকম সন্ন্যাস। হিমালয়ের কোলেও ফুল ফোটে।বাড়ির দালানেও। দুটোই সুন্দর। কখনো যদি কোন ফুল আর শিশুর দর্শন তুমি বুঝে থাকো তাহলে তোমার পৃথিবী অনেক শান্তিময় আর সুন্দর হয়ে উঠবে।
- কিন্তু যারা আমাকে ভুলে বুঝেছে তাদের আমি কি করে বোঝাবো, যে আমি পাল্টাতে চাই নিজেকে। যারা অপমান করেছে, আমাকে নিয়ে খেলেছে, মুখে একরকম বলে কাজের বেলায় যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের ক্ষমা করে লাভ ?
- ক্ষমা করলে শান্তি পাবে। শান্তি পেলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর লাগবে। প্রাণ খুলে শ্বাস নেবে। হাসবে। যে যা করেছে, তাদের ক্ষমা করে দিও। এগিয়ে যাও সামনের দিকে। তারা কেউ আবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে সত্যি ফিরে আসতে চাইছে এরকম মনে হলে ইচ্ছে হলে ফিরিয়ে নিও। নাহলে বুঝিয়ে দিও তুমি ফেরাতে চাওনা। সবাইকে ফেরানোও তোমার দায় নয়। এই পৃথিবীতে তোমার স্নেহ ভালোবাসা র সব থেকে বেশি দরকার তোমার নিজের। কাউকে আবার ফেরাতে গিয়ে নিশ্চিত থেকো সে আবার তোমায় অপমান করবেনা। কেউ না এলে একাই হেঁটে যেও। যে ঠিক বোঝার ঠিক সময় হলে বুঝে নেবে। সেটা তোমার দায় নয়। একটা কথা মাথায় রেখো, আমি বলছি বলে নয়, তোমার রাস্তা তোমাকেই হাঁটতে হবে। একাই।
ট্রেনটা থামলো। বুদ্ধর সম্মোহনী শক্তিতে সবাই তখন বশীভূত। বুদ্ধ ধীর গতিতে নেমে গেলেন। তার সাথে সেই ব্যংগ কর্তাও। বুদ্ধ প্লার্টফর্মে নেমে জানতে চাইলেন - কি ব্যাপার ? এখানে নামলে ?
লোকটি হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল একজন শীর্ণকায় সাধারণ চেহারার শ্বেত বস্ত্র ধারী যুবকের সামনে।
- আমি আপনার সাথে থাকতে চাই।
বুদ্ধ হেসে তার মাথায় হাত দিলেন। সকালের আলো তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

Thursday, June 1, 2017

বর্-অফ্

'ও তাহলে তুই বিয়ে করবিনা, কুমুদ ? '
অবাক হয়ে কুমুদুনীকে প্রশ্নটা করলেন তার কাকিমা ।
কাকিমা মধ্যবয়স্কা প্রাচীনপন্থী, হোমমেকার। স্বামীই তার ধ্যান-জ্ঞান। বিষয়আশয়, সংসার সামলানো, বিকেলবেলা থেকে সিরিয়াল এই তাঁর জীবন।
কুমুদিনী তাঁর মেয়ের বয়সী। সে
একগাল হেসে উত্তর দিল,
'কেন করবোনা? তবে তোমাদের মত নয়। '
কুমুদিনী নামটা তার বাবার দেওয়া। বাবা রবি ঠাকুরের বড় ভক্ত। তাই মেয়েকেও ওইরকম নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু বন্ধুরা তাকে কু-মুড বলেই ডাকে। রবি ঠাকুরের চরিত্রগুলোকে ন্যাকামি রিগ্রেসিভ ছাড়া কিছু লাগেনা তার। কলেজে মাস্টার্স পাস করেছে তার উপর বিজ্ঞানবিভাগে। প্রোগ্রেসিভ লিবারেল চিন্তাভাবনা তার। ওই রবিঠাকুরের চিন্তা লেখাকে তার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পাকামো ছাড়া কিছু মনে হয়না। তার বিয়ের বয়স হয়েছে বলে বাড়ির চিন্তার শেষ নেই।যেন তাকে বড় করেছিল টুক করে বরমালাটা নিয়ে কারো গলায় ঝুলে যেতে। কিন্তু তার হাবেভাবে সেসব নেই। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে সে এক সোচ্চার ভাষণ। তার আশেপাশে ছেলের অভাব নেই। যাদের বা কুমুদের একটু ভালো লাগতো তাদের চরিত্র দেখে তাদের পোষা বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। যেসব বাড়ি থেকে তাকে দেখতে আসে তাদের ছেলেকে একটা ঘরের কোণে ডেকে নেয়। ছেলে ভাবে কতকিছু। কিন্তু কুমুদ আড়ালে ডেকে বলে - 'আমি একজনে সন্তুষ্ট নই।' কুমুদের আর তাই কোন সম্বন্ধ বিয়ে অব্দি গড়ায় না।
এহেন কুমুদের এরকম উত্তর শুনে কাকিমা বললেন - 'আমাদের মত নয় তো বুঝলাম, তো তোর ক্রাইট্রেরিয়া গুলো কি শুনি। '
কুমুদ উত্তর দিল - 'এমন কেউ যে বড়লোকের ছেলে। কম কথা বলবে, কম প্রশ্ন করবে, আমি রেগে ঝেড়ে দিলেও চুপ থাকবে। আমার জীবনের বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোকে ঘাঁটাবেনা। রান্না করে দেবে। কাপড় কেচে দেবে। আমার গা হাত ব্যথা হলে হাত পা টিপে দেবে। আমি মদ খেলাম না সিগ্রেট খেলাম, কোন বন্ধুর সাথে সিনেমা দেখতে গেলাম, ঘুরতে গেলাম তার কোন কিছু বলার থাকবেনা। আমি যখন চাইবো চেষ্টা করবে সময় দেওয়ার। তার বাড়ির দায়িত্ব তার। তাকে আমার বাড়িতে এসে থাকতে হবে, আমার বাবা-মা কে দেখতে হবে। আমার মনে হলে মাঝে মাঝে তার বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসবো। '
এতক্ষণ মুখ হাঁ করে শুনছিলেন কাকিমা। কিছু বলতে গিয়েও বেরলোনা, শুধু একটা কথাই ঢোক গিলে বললেন,
' এরকম কোন শিক্ষিত ছেলে পাবি ? '
'বেশি শিক্ষিত নিয়ে আমি করবোটা কি? চৌধুরী পরিবারে কোচিং সেন্টার খুলবো? '
এরকম কুমুদিনী যে বাড়ির বিয়ের চাপে সত্যি সত্যি একজন ওরকম ঘরজামাই হোমমেকার কে কোথাও থেকে ধরে নিয়ে আসবে কে জানতো। যেদিন প্রথম ছেলেটি চৌধুরীবাড়িতে ঢুকেছিল, দেখে মনে হয়েছিল কোন রাস্তার ভিক্ষুক। দুচোখের তলায় কালি, চুল উস্কো-খুস্কো, দুটো গাল ঢুকে গেছে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে লাঠি। মুখেচোখে এমন একটা বিষাদের ভাব যেন তার থেকে দুখী আর কেউ নেই।
কুমুদ বাড়িতে চালিয়েছে যে এর মা-বাবা মারা গেছে তাই ওরকম।
আর বন্ধুদের কাছে বলেছে, 'একটা গাধাকে পেয়েছি। ট্রেনে বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলাম সেই সময়। মালটা বসেছিলো ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে ক্যাবলার মত তাকিয়ে ছিল। ওকে অনেকভাবে পরীক্ষা করলাম, খেতে টেতে পায়না বলে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মাধ্যমিক পাশ। কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে এখন হাতে কোন কাজ নেই। আমি ভাবলাম, ওকে আমার বাড়িতে আমার বর সাজিয়ে নিয়ে গেলে কেমন হয়। আমার ও আর বিয়ে বিয়ে করে কেউ চেঁচাবেনা। ওর ও থাকা খাওয়া হয়ে যাবে বলে অফারটা দিলাম। ছেলেটা একবাক্যে একবার ঘাড় নেড়ে জানালো সে রাজি। আর এটাও বললো আমি যবে বলবো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। '
কুমুদ ছেলেটির নতুন এক নাম দিয়েছে ঘুড়ি। মুখের ভাব সব সময়ই এক। এক অদ্ভুত বিষাদের ছায়া। বাড়ির সবাই তার কাজে খুব খুশি, তাই শুরুতে আপত্তি থাকলেও এখন সবাই তাকে নিয়ে খুশি। উড়িয়ে নেয় সুবিধেমত যে যখন পারে । রাতে বন্ধ দরজার এপারে কুমুদ খাটে ঘুমায়, ঘুড়ি নীচে মেঝেতে মাদুর পেতে ।
কুমুদের বাবা শুধু মেনে নিতে পারেন না। তাঁর বয়স হয়েছে। ডায়াবেটিসের রুগী। কুমুদকে তাঁর এখনো বাচ্চা মেয়ে লাগে, আজ আছেন কাল নেই। এরকম একজনের হাতে তাঁর মেয়েকে ছেড়ে যেতে মন চায়না।
একবার মেয়েকে এটা নিয়ে বলতে মেয়ে বলেছিল -
' দেখো বাবা, তোমাদের যুগে তোমরা মেয়েদের ঝি-বাঁদীর চোখে দেখেছ। এটা আমাদের যুগ। আমরা ছেলেদের চাকর করে রাখব।'
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। হঠাত একদিন কুমুদের কাকু মারা গেলেন। কাকু ছিলেন পন্ডিত মানুষ। এমন কোন বিষয় ছিলনা যেটা নিয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল না। কুমুদ বলতো চলমান উইকিপিডিয়া। তিনি মারা যাওয়াতে বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এল। এদিকে কাকুর ছেলের আর ছয় মাস পর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, নানারকম এন্ট্রান্স এক্সাম। এতদিন তার বাবাই পড়াতেন। তিনি মারা যাওয়াতে সব দায়িত্ব এসে পড়ল কুমুদের ঘাড়ে। কুমুদ পড়েছে মহা বিপদে। সে পরীক্ষার আগে সাজেশন করে পাশ করেছে। একটা বিষয়ে মাস্টার্স। উ:মা: তে তার যদিও একদম ফুল মার্ক্স অংকে। উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান তাই তাও একটু পড়াশোনা করলে পারবে। কিন্তু কাকুর ছেলের কঠিন অংক গুলো সব মাথার উপর দিয়ে যায়। কোন মাথা মুন্ডু বুঝতে পারেনা কি করবে। কঠিন বিক্রিয়াগুলো কি করবে ধরতে পারেনা। অদ্ভুত অদ্ভুত সব পদার্থবিদ্যার অংক কি করবে বুঝতে পারেনা। সব সাজেশনের বাইরে। অগত্যা বন্ধুদের বলে। বন্ধুরা কে কত ব্রিলিয়ান্ট দেখাতে অংক কষে পাঠায়। সুন্দরী মেয়ের ব্রিলিয়ান্ট বন্ধুর অভাব হয়না। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়।
সে নাহলে এভাবে তাও কিছুটা ম্যানেজ করা গেল।কিন্তু বাংলা, ইংরেজি ? নোট মুখস্ত করে নাম্বার পেয়েছে সে। ভালো নাম্বার পাওয়াতে অনেকে হিংসে তে জ্বলে যখন তার জ্ঞানের সংগে নিজের জ্ঞান জাহির করতে এটা পড়েছিস, ওটা পড়েছিস বলতো তখন সে বলে দিত হ্যাঁ। সে পড়ুক, নাম শুনে থাক বা নাই পড়ুক। প্রেস্টিজ ইস্যু। কিন্তু এখন ? গ্রামার বই পড়বে সে ? নাকি ডিক্সনারি মুখস্থ করবে ? মুখে যখন ফটর ফটর ইংলিশে কথা বলে জানত না এত ভুল বলে। সাহিত্য ভালো জানে বলে দাবী করে এরকম বিজ্ঞানের বন্ধু আছে, কিন্তু কাকুর মতো অথেণ্টিক হবে এরকম কেউ নেই। এমতবস্থায়, তার কাকুর ছেলে যা পারতনা বা চেক করাতে হত, কুমুদ বলতো - তুই টেবিলে রেখে দিয়ে রাতে ঘুমিয়ে যাবি। আমি সময় মত সকালে নিয়ে তোকে যবে হোক চেক করে দিয়ে দেবো।
শুরুতে প্রচুর অংক আটকাতো তার কাকুর ছেলের। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তার কাকুর ছেলে সবই নিজে পেরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এবারে যে পরীক্ষাতেই বসবে পেয়ে যাবে। কুমুদের খুব আনন্দ হল। ভাবলো গিয়ে একবার তার কাকুর ছেলেকে এনকারেজ করা দরকার। ভেবে তার পড়ার ঘরে গিয়ে বললো - 'কিরে ভাই তোর ব্রেন খুলে গেছে দেখছি। আসলে টিচার টা কে দেখতে হবে তো। '
ভাই বললো - 'হ্যাঁ সত্যি আমি তো অবাক হয়ে গেছি। তোকে বলতাম, তোর মাথায় গোবর ভরা। কিন্তু তোর ট্যালেন্ট দেখে মনে হল বাবার থেকেও তুই বেটার। সেদিন ওই অংক গুলো তুই তিন চার রকম ভাবে করে দিয়ে গেলি, আমি ওই ভাবেই ক্লাসে করেছি। জানিস আমায় স্যার কি বলেছেন ডেকে? ইউ আর এক্সেপসানালি ব্রিলিয়ান্ট। তবে উ:মা: এ যেন সিলেবাস মেনেই করি অংক। তবে দি সেদিন ওই জড়তা ভ্রামকের অংক টা আমি বুঝতে পারছিনা তুই কিভাবে করেছিস ?'
দিদি এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল। সে যে এত ব্রিলিয়ান্ট সে নিজেই জানতনা।তার বন্ধুরা এত কাজের ভেবেই ভালো লাগছে। সে বললো কই দেখি খাতা ?
ভাই খাতা এগিয়ে দিল। খাতায় করা চিন্হ গুলো দেখে তার মাথা গেল ঘুরে। এসব কি ? 'কে করেছে এগুলো ? ' বলে উঠলো কুমুদ।
সেদিন ঘরে একটা সভা বসলো। কুমুদ আত্মাতে বিশ্বাস করতো না। কিন্তু এই ঘটনার পর ? প্রায় হুবহু তার কাকার মত জঘন্য হাতের লেখায় হিজিবিজি করে একের পর অংক নানারকম ভাবে করা। কেউ যেন মোবাইল গেম খেলার মত আনন্দ নিয়ে করেছে অংক গুলো। প্রত্যেকটা সমাধানের পর লেখা 'গেম ওভার'। বাড়িতে যে কয়েকজন লোক, কুমুদ ছাড়া কারো ধারে কাছে শিক্ষা নেই যে ওইভাবে অংকগুলো নিয়ে খিল্লি ওড়াবে। শুধু তাই নয় বাংলা, ইংরেজি তেও যেরকম ভাবে কারেকশন করেছে। প্যারাগ্রাফ, বিশ্লেষণ অসাধারণ। সহজ সরল ভাষায়, যেখানে যে টার্ম একদম দরকার সেখানে সেটা। এটা কাকু ছাড়া কেউ পারতো না। মারা যাওয়ার পরও কাকু তার ছেলেকে দেখাচ্ছেন এভাবে।
বাড়িতে সবাই ঠিক করলো ব্যাপারটা কাউকে বলার দরকার নেই। গয়া তে কাকুর পিন্ডি দেওয়া হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পরেরদিনই টিকিট কাটার কথা ছিল, যদি না আবার একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতো বাড়িতে। ভাই এর মৃত্যুর পর কুমুদের বাবা খুব ভোলা মনের হয়ে গেছিলেন। তার উপর সেদিন বিকেলে যখন জানতে পারলেন তার ভাই এর আত্মা এখনো শান্তি পায়নি, আরো আনমনা হয়ে গেলেন। তারপর দিন সকালেই হঠাত অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কুমুদ তার বাবা শুয়ে আছে মাটিতে দেখে ঘুড়ি কে ডাকতে লাগলো চেঁচিয়ে। একটু দূরে ওখানকার ডাক্তার নৃসিংহ বাবু আছেন ঘুড়ি সাইকেলে করে গিয়ে, ডেকে নিয়ে আসবে। তার ভাইও ঘরে নেই। ওই বোধহয় সাইকেলটা নিয়ে গেছে। মাথা কাজ করছিল না। কুমুদ নিজেই ছুটে গেল ডাক্তার ডাকতে। কুড়ি মিনিট পর যখন ডাক্তার নিয়ে কুমুদ বাড়ি এল, দেখল, বাড়ির লোকেরা একটা ঘরের বাইরে উঁকি ঝুঁকি মারছে। সাইকেলটাও যথাস্থানে।মানে ভাই ফিরে এসেছে। কিন্তু সে ও তো বাইরে উঁকি ঝুঁকি মারছে। ব্যাপারটা কি ? বাবার কিছু হল না তো ? ছুটে গেল ডাক্তার কে নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল একি। ঘুড়ি !! তার বাবার এক হাতে স্যালাইন চলছে। আর ঘুড়ি তার বাবার পায়ের কাছে হাত দিয়ে ঘষছে। ডাক্তার চেঁচিয়ে বললেন, একি বাড়ির চাকরের হাতে একজন মানুষের স্বাস্থ্যকে ছেড়ে দিয়েছে।
কুমুদ তেড়ে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তাকে থামিয়ে দিয়ে ওর বাবা বলে উঠলো জড়তা ভরা স্বরে। 'ও চাকর নয় ' বলে চোখ মিললেন।
'বাবা তুমি ঠিক হয়ে গেছ? ' বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো কুমুদ।
এবার মুখ খুললো ঘুড়ি।
নৃসিংহ বাবুকে বললো - নমস্কার আমি ডা: স্বপ্নলোচন দত্ত। এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ। ইট ওয়াজ জাস্ট আ সিম্পল কেস অফ ডায়াবেটিক হাইপোগ্লাইসেমিয়া, দেখে বুঝতে পারি, কিন্তু ইমিডিয়েট ট্রিটমেন্ট দরকার ছিল। তাই কাউকে কিছু না বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে। এখন ভয়ের কারণ নেই। কিন্তু খাওয়া দাওয়াটা ঠিক করে করতে হবে। আর আমি ফিরে দেখি ওনাকে জড়িয়ে ধরে সবাই কান্নাকাটি করছিল। ওটা ওনার হেলথের জন্য ভালো ছিলনা একেবারেই। তাই সবার সাথে বাজে ব্যবহার করতে হয়েছে, তাই দু:খিত।
যে দরজাটা বন্ধ ছিল, সেই দরজাটা ঠেলে আগেই খুলে দিয়েছিল কুমুদ। এতক্ষণ বাড়ির সবাই বাইরে ছিল তারা সবাই ভেতরে এসে হাঁ করে সব শুনছিল।
কুমুদের ভাই হঠাত বলে উঠলো- তুমি আমার জড়তা ভ্রামকের অংকটা বুঝিয়ে দিতে পারবে ?
স্বপ্নলোচন বললেন - নিশ্চয়ই ওগুলো আমারই করা।
কুমুদের বাবা বললেন - ও তুমিই তাহলে ভূত।
'ভূত না বরফের ছুরি।'
কথাটা বলেই কুমুদ গট গট করে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে কুমুদের ঘরে ঢুকলো স্বপ্নলোচন। দেখুন, ব্যাপারটা হল। আমি হায়ার এডুকেশনের জন্য একটা পরীক্ষায় বসেছিলাম, আমার অনেক বন্ধু পাশ করেছে। যে কারণেই হোক আমি পারিনি।এক বছর বেকার হয়ে বসেও পারলাম না। জীবনে কখনও চেষ্টা করে পারিনি এটা হয়নি। তার উপর মাথায় নিউরোফিজিক্স নিয়ে থিওরি বের করার ভূত ঘুরছিল। ফেল করে মাথাটা পুরো ঘেঁটে গেছিল। ভাবলাম তাহলে গান করি। কিন্তু কি লাভ। চাকরি নিতেও মন চাইলোনা। আমার বাড়ি আছে। কিন্তু এই পৃথিবীতে সব কিছুই ব্রম্ভ, মায়া মনে হল। সব দু:খের মূলে অসন্তুষ্টি। সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে ছিলাম। আমি কে? জীবন কি? আমার উদ্দেশ্য কি? খুঁজতে। আজ খুঁজে পেয়েছি। আপনার বাবা ঠিক হওয়ার পর আপানার মুখের হাসি দেখে। আমি ফিরে যাব। বাড়িতে কোন গ্রামের ডাক্তার হয়ে। ওখানে এরকম কত বাবা মা আছেন। যারা চিকিতসার অভাবে মারা যান। ওখান থেকেই বাকি জীবনটায় নিজেকে এক্সেলেন্ট করবো। আপনারা আমায় এতদিন থাকার জায়গা দিয়েছেন, আমি কৃতজ্ঞ। '
ফিরে তাকালো কুমুদ। তাদের ভেতরে এতদিন যে একটা সম্পর্ক ছিল হঠাত সে অনুভব করতে লাগল। সে বরফ টা গলে গিয়ে কখন যে কাউকে সে বর্-অণ করে নিয়েছে নিজেই বুঝতে পারেনি। মুখ ফুটে বলতে চাইলো অনেক কিছু। কিন্তু বেরলোনা। এতদিন এতকিছু করেছে ওর সাথে ক্ষমা চাইতেও কেমন লাগে। বলতে ইচ্ছে হল তুমি ফেল করনি। তার কাকু ছোটবেলায় তাকে বলতেন হিন্দুধর্মের মূল কথা - ঈশ্বর ই আসল কথা, তিনি যে পথে নিয়ে যান, যা কিছু দেন সেটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত, মা গৃধ কস্যচিত ধনম্ ।
কাকুকে সে জিজ্ঞেস করতো - এরকম কাউকে দেখেছো যে খুব জ্ঞানী কিন্তু সন্তুষ্ট ?
কাকু বলতো - না। তবে এরকম কাউকে পেলে তাকে কখনো যেতে দিস না। কারণ সে সত্যর পথ খুঁজে পেয়েছে।
আজ তাকেই, সেই স্বপ্নকেই চোখের সামনে নিজের চোখে দেখছে কুমুদিনী।যে মাটিতে শোয়, নিজের রান্না নিজে করে খায়, যে বস্তুবাদী চিন্তা থেকে দূরে।এই প্রথম তার ঘুড়ির মুখে এত কথা শুনলো আর হাসি দেখলো কুমুদ।
ঘুড়িটা একটু হেসে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।হয়তো কোন খোলা আকাশের সন্ধানে।

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...