Monday, February 24, 2020

নীলরতনের পাঁচ রতন | প্রথম পর্ব | Pilot |


(এই রচনার সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক)
স্ক্রোল করতে করতে যদি মনে হয় একটু আমার জীবনের গল্প ও শুনে যাবেন। আমি ধর্মদাস। বয়স ৪০ বছর। তা বলে কাকু, জ্যেঠু বলে ডাকবেন না। আমি হলাম গিয়ে ২০৩০ সালে দাঁড়িয়ে ১৮ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ১৮ বছরের যুবক। আর বাকি চার বছরটা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছি। আসলে প্যান্ট ভেজাতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম রিভিশন দেওয়া হয়নি। তাই মানে কথা, মনে পড়ছেনা। আমাদের সমবয়স্ক পাঁচ বন্ধুর একটা গ্রুপ আছে। ১৮ বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম জীবনটা আসলেই ফাঁকা। তোমার জন্য কেউ ভাববেনা। কলেজে পড়াকালীন হস্টেলে যখন প্রথম এসেছিলাম  তখন হ্যান্ডওয়াশ টা বারান্দার পাশে জানালায় রেখে আসার ভুল করেছিলাম৷ দুই মিনিট পরে তাকিয়ে দেখি সেটা আর নেই। আধ ঘন্টা পরে দেখি সেটি আবার যথাস্থানে। মানে কোন জনাব সেটি নিজের মনে করে নিয়ে গেছে এবং যথাস্থানে রেখে গেছে। কিন্তু যখনই বাথরুমে আধ ঘন্টার কার্য কারণ বিবেচনা করেছি ওই হ্যান্ড ওয়াশটা আর ব্যবহার করতে পারিনি। ওই অজানা ব্যক্তিই ওটি ব্যবহার করে শেষ করেছেন। এত নির্লজ্জ শেষ হওয়ার পর আবার নোট ও রেখে গেছিল - " ওরে বাল, হ্যান্ডওয়াশ টা কি আমার বাবা কিনে দিয়ে যাবে? "
সেদিন থেকে শেখার শুরু। পৃথিবীটা আসলে এইরকমই। ব্যাপারটাকে কমেডি হিসেবে দেখি। কারণ কমেডি ইজ দ্য বেস্ট রেমেডি।
তো আমিও একটা কাগজে লিখে হ্যান্ড ওয়াশের কাছে লিখে দিলাম - "হে মহানুভব, আমি আপনার মত মহাত্মার দর্শনাকাঙ্ক্ষী। আপনার উদ্ঘট রূপ সচক্ষে দর্শন করতে এই গরীব জীবাত্মার মন চায়। "

তারপর আমার সাথে সেই মহাত্মা নিজে পরিচয় করতে আসে। সে হয়ে যায় আমার কলেজ জীবনের প্রথম বন্ধু। ছেলেটি আমারই ব্যাচের। তাই খুব কম দিনেই আমরা এত কাছাকাছি চলে এলাম যে আমাদের নামে সমকামিতার গুজব রটতে লাগলো। এটাকেও আমরা কমেডি হিসেবে নিতাম। একদিন আমি আমার অমিত শাহের সাথে হস্টেল পরিদর্শনে বেরিয়েছিলাম। দেখলাম একটি রুমে একজন হৃষ্টপুষ্ট যুবা উলংগ হয়ে গিটার জড়িয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। এতটাও মোটা নয় যে তার চারপাশে স্পেস টাইম কার্ভেচার বেঁকে যাবে, কিন্তু বেশ নাদুস নুদুস টাইপের। ভগার মতে ছেলেটি যদি আরেকটু মোটা হত ওর অন্ডকোষ দুটো ওকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করতো। তাকে দেখে চলমান কমেডি র এনসাইক্লোপিডিয়া মনে হল। তাকে ডেকে তুললাম। সে যেন কিছুই হয়নি ভেবে গামছা পরে নিল। তাকে নিয়ে পরেরদিন কলেজে ক্লাস করতে গেলাম। এতক্ষণ বলা হয়নি আমরা নীলরতন মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষে তখন এম.বি.বি.এস পড়ি। আমি ধর্মদাস, নাম আগেই জানেন। ডাক নাম ধীরু। থাকতাম এনেক্স্ বিল্ডিং এর একটি রুমে। আমার রুম থেকে শিয়ালদহ স্টেশন ও তত্সংলগ্ন বিশাল উঁচু ফ্ল্যাটের মাউন্টেন ভিউ পাওয়া যেত। আমার পাশের জানালাতে ছিল ডক্টরস্ কোয়ার্টার। আমার রুম ছিল বাথরুমের প্রক্সিমালি। হ্যান্ডওয়াশ চোর এর নাম ভগা। সে আমার ফ্লোরেই থাকতো বাথরুম থেকে ডিস্টালি।  আর ওই হৃষ্টপুষ্ট যুবার নাম নীল। ও থাকতো আমাদের ফ্লোরের নর্থ উইঙ্গে। আমার রুমের জানালার পাশেই যে ডক্টরস্ কোয়ার্টার ছিল, সেখানে একটি মেয়ে রোজ সন্ধ্যেবেলা ছাদে আসতো। ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ্য করে শিলু। শিলু আমার উপরের ফ্লোরে থাকতো। কিন্তু মাঝেমধ্যেই আমার রুমে ঝটিকাসফর সেরে যেতো। শিলু একদিন আমার রুমে এসে মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে বললো - "ওই দ্যাখ্, মাইয়া। "
আমি একটু রবীন্দ্রনাথ ভক্ত।
"আমার আনন্দ সকলের আনন্দ হউক " বাণীতে বিশ্বাসী। ভগা কে ফোন করে ডাকলাম - "ভাই, ব্যস্ত? "
বললো - "হ্যাঁ পড়ছি "
আমি কাব্য করে বললাম - "সন্ধ্যের সূর্যাস্তের মাঝে অপ্সরা দেখতে চাইলে রুমে এসো"
ভগা ফোনটা কেটে দিল। অগত্যা আমি আর শিলু দুজন আবার কাঁধে কাঁধ রেখে গালে হাত দিয়ে মেয়ে দেখাতে মনোনিবেশ করলাম। ভগা আসবেনা ভেবে খারাপ লাগছিল, এমন সময় দেখি, ভগা শুধু নিজেই আসেনি, নীলকেও ধরে নিয়ে এসেছে কই, কই করতে করতে।
শিলু বললো - হবে কোন ডাক্তারের মাইয়া। আমি এক মাসে পটাইয়া ফেলমু।
এরই মাঝে বাজি ধরাও হয়ে গেছে দু টাকার। যদি শিলু না পটাতে পারে এক মাসে তাহলে দু টাকা দেবে আমাদের। যাই হোক্, এরকমই চলছিল আমাদের জীবন। হঠাৎ জীবনে এসে গেল প্রথম পার্ট পরীক্ষা। ভগা বললো -" চল্ হস্টেলে কে কেমন পড়ছে সরেজমিনে তদন্ত করে আসি। "
নীলের রুমের দিকেই যাচ্ছিলাম, দেখলাম নীলের পাশের রুমে একটা ছেলে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। নীলের কাছে শুনলাম সে নাকি আমাদেরই ব্যাচের। কিন্তু প্রচুর অলস৷ ও নাকি এত অলস যে ওকে ছাদ থেকে ফেলে দিলেও গ্র‍্যাভিটি স্লো হয়ে যাবে। কারণ ওর অবাধে পতনশীল হতে কিঞ্চিৎ ক্লেশ অনুভব হবে। ট্রেভর চ্যাপেল নাকি টাইম মেশিনে এসে ওর কাছে আন্ডার আর্ম বোলিং শিখেছিল৷ কারণ ফুল আর্মে ল্যাদ লাগে।
 ছেলেটির নাম - বিশু।
বিশুকে উঠিয়ে আমরা পড়তে বসালাম। রামায়ণের প্রিয় চরিত্র যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বিশু রাম-রাবণ-হনুমান-মায় ইন্দ্রজিৎ কারো নাম বলেনি।
ওর আইডল হল কুম্ভকর্ণ। অলস আমরাও কম বেশি ছিলাম। কিন্তু ও হাইবেরনেশন জিনিসটা একটু বেশি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছিল। বেশ কিছুদিনের মধ্যেই আমরা চারজন মানে আমি, ভগা, নীল ও বিশু খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। আমরা ক্লাসে পেছন থেকে বসা শুরু করতাম। একদিন আমি এরকম প্র‍্যাক্টিক্যাল ক্লাসে বসে আছি। ভগার জ্বর, তাই আসেনি। নীল আর বিশু অন্য প্র‍্যাক্টিক্যাল ব্যাচে। তাই একাই বসেছিলাম। পাশ থেকে একটা ছেলে ফিশফিশ করে বললো - "ক্লাস শুনতে ভালো লাগছে? "
আমি বললাম -" না, এটেন্ডেন্স এর জন্য আসা। "
সে বললো - " কেন প্রক্সি দেওয়ার লোক নেই? আমরা তো পালা করে ক্লাস করি। "
আমি বললাম -" না আরেকজনের জ্বর। "
সে বললো - " তোর নাম কি? "
- " ধর্মদাস"
ছেলেটি খিক খিক করে হেসে উঠলো। ক্লাসের ম্যাডাম আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন - "হেই, হোয়াট আর ইউ টকিং?"
বাংলা মিডিয়াম আমি থতমত খেয়ে বললাম - "নাথিং টকিং "।
গোটা ক্লাস এতক্ষণে চুপ ছিল। আমাকে মুরগীর মত আওয়াজ বের করতে দেখে হেসে উঠলো।
ম্যাডাম বললেন - "নাথিং টকিং!! প্লিজ গেট আউট। "
আমি বললাম - "নো ম্যাম, আই ডোন্ট থিংক সো। "
এবার ম্যাডাম ট্রোল হয়ে গেলেন। ম্যাডাম বুঝলেন পচা শামুকে পা কেটে গেছে। বাংলা মিডিয়াম যে কি জিনিস! যাই হোক্, ম্যাডাম আবার পড়াতে শুরু করলেন আমাকে বসতে ইশারা করে। পাশের ছেলেটি হাসতে হাসতে বললো - "আমার নাম শিবেন। বেহালা থেকে রোজ আসি। শিবের প্রসাদ খাবি ক্লাসের পর?  এই যে ক্লাসের জাংক মাল গুলো গিলছিস পুরো ক্লিন হয়ে যাবি। "
আমি তখন বুঝতে পারিনি শিবের প্রসাদ কি? ওকে ভুলভাল ছেলে ভেবে হস্টেলে ফিরে এসেছি।
আমার রুমমেট ছিল দুজন সিনিয়র দাদা। আমার এক বছরের সিনিয়র দুজনে। একজনের নাম অরুণ দা, আরেকজন প্রবাল দা। অরুণ দা ছিল পড়াকু টাইপের। কিন্তু যখন জুনিয়র পেতো বিষাক্ত হয়ে যেতো। ও তোতাপাখির মত বইএর কাগজ গিলতো, আর যে হতাশা তৈরি হত সেটা জুনিয়রকে গালাগাল করে বের করে দিত। আমি এটাকেও কমেডি হিসেবে দেখতাম। প্রবাল দা আবার একটু অন্যরকম। জুনিয়র পেলে জিভ থেকে জল ঝরতো, তার সাথে পাগল ছিল। আমাদের হস্টেলে যে চা বিক্রি করতো রুমে রুমে তার নাম ছিল পলাশ দা। পলাশ দা শাহুরুখ খানের ভক্ত ছিল। প্রবাল দাও। শাহুরুখ খানের যখন সিনেমা মুক্তি পেত,  প্রবাল দা আর পলাশ দা দুজন মিলে পার্ক সার্কাসে সিনেমার লিফলেট বিলি করতো। চুলটা ছিল অদ্ভুত। একটা কেশ বিন্যাস নেমে আসতো কপালের উপর আর মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা মাথায় তুলে নিতো দাদা। তো আমি এই বাংলা মিডিয়াম, একটা মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। শিবের নাম শুনেছি, কিন্তু পূজো নিয়ে উত্সাহ না থাকায় প্রসাদের ব্যাপার টা জানিনা। এমনিতেও ভেঙ্কটেশ প্রসাদের বোলিং বেকার লাগতো। তবুও কৌতূহলবশত প্রবাল দাকে এসে জিজ্ঞেস করলাম - দাদা শিবের প্রসাদ কেমন খেতে?

প্রবাল দা আঁতকে উঠলো। অরুণ দা বই বন্ধ করে নেমে এলো। তারপর আমাকে সে কি অপূর্ব ভাষার প্রয়োগ। আমাকে জিজ্ঞেস করলো -
সিগারেট খাস?
আমি বললাম - না, আমি শুধু দুধ খাই।
- দুধ খায়! তুই উপুড় হয়ে চার পায়ে বস। আর তোর হোমো পার্টনার ভগাকে ডাক। সে তোর দুধ খাবে।

সে কি লজ্জার কথা। শেষে একটা উত্তরে ব্যাপারটা শেষ হয়েছিল।
আমাকে অরুণ দা বললো - তুই প্যান্টের নিচে কোন কোম্পানির পরিস রে?
আমি বললাম - বাটা কম্পানির হাওয়াই চপ্পল।
এই সেমসাইড গোলে আর এগোয়নি। সেদিনের মত মাঝরাতে চাঁটন টা শেষ হয়ে গেছিল। চাঁটের এফেক্ট এমন ছিল যে ভগা আমার রুমে এলে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে নিত ওই দুই দাদা আছে কিনা। যাই হোক, দাদাদের কাছে কোন উত্তর না পেয়ে অগত্যা বাকি চারজনকেও ব্যাপারটা বললাম - "ভাই, শিবেন বলে একটা ছেলের কাছে শিবের প্রসাদ পাওয়া যায়। বলেছে খেলে নাকি সব জাংক ক্লিয়ার।"

বিশু বলল - "কদিন ধরে প্রচন্ড কনস্টিপেশন হচ্ছে। চাপ দিতে খুব ল্যাদ লাগে। এই শিবের প্রসাদ টা তো চেখে দেখতেই হয়। "

পরেরদিন শিবেন কে হস্টেলে ডেকে আনলাম। সেই আমাদের পাঁচজনের একসাথে পথ চলা শুরু।

(এরকম লেখা আরো পেতে ব্লগটি ফলো করে রাখুন ইমেল আই ডি দিয়ে। লেখাটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন, নিজের এরকম বন্ধুর সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না)
( To be continued...)  

Saturday, February 15, 2020

বোহেমিয়ান ডায়েরি - গড় পঞ্চকোট সার্কেল, পুরুলিয়া

"খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে "
এই ছড়া ছোটবেলায় মা, ঠাকুমার মুখে নিশ্চয়ই সবাই শুনে থাকবেন। এই বর্গীদের সন্ত্রাস বাঙালী মননে কতটা ব্যাপক ছিল এটা থেকে আন্দাজ করা যায়। এই বর্গী অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর ধরে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে লুটতরাজ চালাত এরা। বর্গীরা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে ব্যাপক লুণ্ঠন চালাতো ওই সময়।
 গড় পঞ্চকোট সার্কেল বলতে পাঞ্চেত বা পঞ্চকোট পাহাড়, জয়চন্ডী পাহাড়, পাঞ্চেত ড্যাম, বড়ন্তী পাহাড় ও লেক, মুরারডি ড্যাম, বোরো পাহাড় ইত্যাদি। এই পাহাড় গুলো সবই ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ।
এটি এমন একটা সার্কেল যেখানে ইতিহাস, ভূগোল ও প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটে৷ যাই হোক্, আমি আর আমার ভাই একদিন বেরিয়ে পড়লাম অভিযানে।  আমাদের নির্দিষ্ট কোন প্ল্যান কিছু ছিলনা। কখন কি খেতে পাবো ঠিক নেই, তাই হাওড়া থেকে কিছু শুকনো ফল কিনে নিয়েছিলাম। রাতে হাওড়া স্টেশনে খেয়ে চক্রধরপুর এক্সপ্রেসে চেপে ভোর ৫.১০ এ নামলাম আদ্রা জংশনে। যখন নামলাম তখনো আদ্রা তে ভোরের আলো ফোটেনি আর কনকনে ঠান্ডা। আমরা ভালোরকম শীতের পোশাক গায়ে চাপিয়ে নিলাম। আমার ভাই জিজ্ঞেস করলো - এরপর কোথায়?
আমি বললাম - জানিনা। আমরা ট্রাভেল করবোনা, এক্সপ্লোর করবো।
গুগল ম্যাপে দেখলাম আদ্রা থেকে সব থেকে কাছে জয়চন্ডী পাহাড়৷ তিন কিলোমিটার দূরত্ব৷ দিনের শুরুতেই বেশি শক্তিক্ষয় করে লাভ নেই, তাই না হেঁটে আমরা অটোতে উঠলাম। অটো রিজার্ভ করে গেলে যে যা খুশি ভাড়া বলে, তাই আমরা পাবলিক অটো তেই উঠলাম৷ জয়চন্ডী পাহাড় মানে যেখানে "হীরক রাজার দেশে" সিনেমার কিছু শুটিং হয়েছিল। অটোতেই অটোচালক কে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশন থেকে মধুকুন্ডা স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটো ধরে বড়ন্তী পৌঁছানো যাবে। তবে অটো সহজে পাওয়া যায়না। তাই রিজার্ভ করে যাওয়াই ভালো। অটো থেকে নেমে আমরা কিছুটা হেঁটে জয়চন্ডী পাহাড়ের পাদদেশে এলাম। যে পাহাড়ে চন্ডী মন্দির আছে সেখানে সিঁড়ি করা আছে। যাদের হার্টের সমস্যা রয়েছে তাদের না ওঠা বা সাবধানে ওঠাই ভালো। নাহলে সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির এ পৌঁছাতে খুব একটা কষ্ট হবেনা। সিঁড়ির দুধারে কিছু মানুষরূপী জানোয়ার দেখলাম প্রচুর প্লাস্টিকের প্যাকেট ফেলে রেখেছে। মানুষ শিখবে কবে? মন্দির পৌঁছানোর আগেই একটা ভাঙা টাওয়ার সিঁড়ির ডানদিকে পড়বে। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওটা ওয়াচ টাওয়ার ছিল একসময়ে। জানিনা কতটা সত্যি। জয়চন্ডী পাহাড়ের বাকি চূড়াগুলো কে মনে হচ্ছিলো শিবলিঙ্গের মত। সূর্য ওঠার আগে চাঁদ তাদের মাথায় শোভা পাচ্ছিল। পাহাড়ের চূড়া থেকে যখন চারপাশের সৌন্দর্য কে আমরা উপভোগ করছি, তখন কুয়াশার লেপ সরিয়ে সূর্যের ঘুম ভাঙলো।
 যেন মনে হল গুপী গাইন কানের ধারে গাইছে,
দেখো রে নয়ন মেলে, জগতের বাহার, দিনের আলো ঘোচায় অন্ধকার।
বেশিক্ষণ আমরা ওখানে থাকিনি। ট্রেন ধরে আমরা মধুকুন্ডা নামলাম। ওখান থেকে ট্রেকারে বড়ন্তী লেক।  তখন সকাল দশটা বাজে। বড়ন্তী লেক সূর্যাস্তের জন্য বিখ্যাত। তবে আমার মনে হলনা দিনের বাকি সময়ের সৌন্দর্য ও কোন অংশে কম। বড়ন্তী লেকের চারিদিকের বাঁধ ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম বড়ন্তী নদী পেরিয়ে লেকের ধারের বাঁধের রাস্তা দিয়ে। জায়গাটার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় লোকাল হোটেলগুলো তৈরির জন্য ইঁট মাটি পুড়িয়ে  এখানেই তৈরি হয়। আমরা একটা রিসর্টে তাঁবু ভাড়া নিলাম। তাঁবুতে ব্যাগ রেখেই আমরা কিছু খেয়েই পাশের পাহাড়ে ওঠার পথ খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। স্থানীয় গ্রামের মানুষদের জিজ্ঞেস করে জানলাম ওরা এই জংগল পেরিয়েই পাহাড়ে ওঠে। জংগলে বুনো শুয়োর থাকতে পারে বলে সাবধান করে দিল আমাদের। আমরা দুজন ওসবে পাত্তা না দিয়ে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে পাহাড়ে ওঠার রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। হঠাত্ আমাদের চারিদিকে খসখস আওয়াজ হতে লাগলো। চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, আমাদের চারিদিকে বুনো শুয়োর। আমরা কোনক্রমে ছুটে ওখান থেকে পালালাম। জংগলে ছুটতে গিয়ে আমার পা একটু কেটে গেল। যাই হোক্, এবার ঠিক করলাম, পাহাড়ে উঠে আর কাজ নেই, ফেরা দরকার। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, ফ্রয়েড সাহেব বলে গেছেন, "If you can't do it, Give up".. কিন্তু ফিরবো কি করে? যেদিকে তাকাই সেদিকে জংগল, ফেরার রাস্তা কোথায়! পথ হারালেই ভরসা গুগল ম্যাপ। মোবাইল খুলে দেখলাম নেটওয়ার্ক নেই। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর নেট পেলাম।  গুগলের সহায়তায় আমরা পীচ রাস্তায় ফিরে এলাম। তাঁবুতে ফিরেই ঠিক করলাম আর নয়, এবার লাঞ্চ খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই এখান থেকে পালাবো। দুপুরে হোটেলে অসাধারণ খেলাম। খিদেও পেয়েছিল চরম। খেয়ে দেয়ে আমরা দুজন তাঁবুতে ঢুকে একটু বিশ্রাম নিলাম। তাঁবুর মধ্যে হাল্কা রোদ এসে লাগছিল। আর একটা অদ্ভুত নেশা ধরানো মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছিলো। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল বিভিন্ন পাখির ডাক, আর মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে ট্রাক যাওয়ার আওয়াজ। আমরা দুজন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। ভাই কে বললাম - "বুঝলি, মানুষ চেনা কঠিন, তাই মানুষের কথা বলতে পারবোনা৷ কিন্তু কোন জায়গায় গিয়ে একটা রাত অন্তত না কাটালে চেনাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। "
ভাইও থেকে যেতে চাইলো। আমি বাথরুমে পা ধুতে গেলাম৷ ওখানকার ঠান্ডা জল হেঁটে হেঁটে ব্যথা হওয়া পা কে পুরো জুড়িয়ে দিল। আমি ঠান্ডায় স্নান করতে একেবারেই পছন্দ করিনা। তার উপর ঠান্ডা জলে? নৈব নৈব চ। কিন্তু এই জলে কি ম্যাজিক আছে জানিনা, গামছা নিয়ে চরম আনন্দের সাথে স্নান করলাম। গোটা শরীর ব্যথা করছিল দৌড়াদৌড়ি করে। পুরো শরীরটা যেন চাংগা হয়ে গেল। ভাইকেও বললাম স্নান করতে৷ ভাই স্নান থেকে ফিরে দেখলো আমি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি। বিকেল সাড়ে তিনটেয় আমরা আবার বেরোলাম লেকের ধারে সূর্যাস্ত দেখতে। পরের দিন গড় পঞ্চকোট যাবো কিভাবে সেটা স্থানীয় মানুষদের কাছে জানলাম। বুঝলাম স্থানীয় মানুষেরা খুব কম বাইরে যান। গেলেও বাইক বা সাইকেলে। সারা দিনে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে ট্রেকার, তাও খুব কম। এইসব জায়গায় গেলে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়াই ভালো। কিন্তু গাড়ি ভাড়ার দাম শুনে ভাবলাম থাক। যেভাবে এখানে এসেছি সেভাবেই যাবো। সন্ধ্যে নামতেই বড়ন্তী লেকের চেহারা পুরো পাল্টে গেল। এই মায়াবী পরিবেশের ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বোরো পাহাড় ঘেঁষে সূর্য নামলো। ঠান্ডাও বাড়তে শুরু করলো। আমরা তাঁবুর ভেতর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকলাম। এই শান্ত পরিবেশে হঠাৎ দূরের কোন হোটেলে বক্স বাজতে লাগলো। বেশিক্ষণ না বাজলেও এটা বুঝলাম এলাকাটায় বেশি মানুষ না আসা একদিক থেকে ভালো। স্থানীয় আদিবাসীরা শিক্ষিত মানুষদের থেকেও পরিবেশকে ভালোবাসতে জানে৷ রাতে মাংস ভাত খেয়ে আমরা শুতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। শোয়ার আগে ভাবছিলাম, জীবন যদি এতটাই সহজ সরল হয়, আমরা কেন তবে একে জটিল করে তুলি।
এত প্রতিযোগিতা, মারামারি, হানাহানি, নিজেকে এত বড় করে দেখানোর চেষ্টা.. প্রকৃতির কোলে মানুষ হলে মানুষ বোধহয় এত গাম্বাট তৈরি হতনা। আমরা যত প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি তত আমরা গাম্বাট তৈরি হচ্ছি। আগামী দুটো দশক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই কুড়িটা বছর আমাদের কাজের উপর নির্ভর করছে, পৃথিবীতে মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ। আমরা যেভাবে পরিবেশকে ধ্বংস করছি, সেভাবেই যদি করতে থাকি, তাহলে খুব শিগ্রি কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন এর শিকার হবে। বাকিরা রোগে মারা যাবে। যাই হোক, পরেরদিন সকালে উঠেই আমরা ট্রেকার ধরতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঠিক সাড়ে আট টায় ট্রেকার ধরে আমরা পৌঁছলাম মধুকুন্ডায়।  সেখান থেকে বাস ধরে সরবড়ি। তারপর অটো ধরে পুয়াপুর মোড়ে নামলাম৷ পুয়াপুর মোড় থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এর রিসর্ট হেঁটে এক মাইল। আমাদের হাতে যেহেতু গুগল ম্যাপ রয়েছে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। পুয়াপুর মোড়েই বড় বড় কারেন্টের তার থেকে একটা বাজিং সাউন্ড পাওয়া যায়, শব্দটা আমার খুব ভালো লাগল। জংগলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা দিয়ে আমরা গান গাইতে গাইতে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। রুমে ব্যাগ রেখে খেতে এলাম। খেয়ে বেরিয়ে আমার এক স্কুলের ব্যাচমেটের সাথে দেখা। ও ঘুরতে এসেছে। আমরা ঠিক করলাম এখনই ফরেস্ট বাংলোর পেছনের রাস্তা ধরে পঞ্চকোট পাহাড়ে উঠবো। যেমন ভাবা তেমনি কাজ৷ রাস্তার শুরুতেই অনেক হনুমানের দাপাদাপিতে একটু ভয় পেলেও আমরা চুপচাপ চলে যাওয়াতে ওরা কিছু করলো না। কিন্তু মাঝপথে হল বিপত্তি। আমার ব্যাচমেটটির এক্রোফোবিয়া, মানে উচ্চতা তে ভয় থাকার জন্য। সে দেড়শো মিটার মত উঠে আর উঠতে চাইলোনা। আমি আর আমার ভাই অগত্যা দুজনেই উঠতে শুরু করলাম। যত উপরে উঠছি তত পথ খাড়াই হচ্ছে। আমার পায়ে ছিল সাধারণ কিটো জুতো। ট্রেকিং শু না থাকার জন্য মাঝে মাঝেই পা পিছলে যাচ্ছিল। একদম শেষ দিকে পথ এতটা খাড়া আর ওঠার সাহস হল না এই কিটো পরে। অগত্যা আবার নেমে এলাম। ফিরে স্নান করে আমরা খেয়ে দেয়ে আবার বেরোলাম পাঞ্চেত ড্যাম দেখবো বলে। হেঁটে পুয়াপুর মোড়ে এসে একটা ঝাড়খন্ডের অটোতে চাপলাম। এই বাহনের চালক বেশ সহজ সরল। নাম মানিক লাল৷ সে আমাদের বললো - টাকাটা বড় কথা নয়। আপনারা ঘুরতে এসেছেন আপনাদের ঘোরানো আমার কাজ।
পাঁচশো টাকায় সে ঝাড়খন্ডের ঝরণা ঘুরিয়ে আবার গড় পঞ্চকোট পাহাড় ঘুরে মন্দির ঘুরিয়ে ফরেস্ট বাংলোতে ছেড়ে দিতে রাজি হল। আগের দিন থেকে যা দৌড় ঝাপ করেছি আর করতে ইচ্ছে হলনা। পাঞ্চেত ড্যামে পৌঁছে বাহনের চালক মানিক লাল কে বললাম, তোমার সাথে একটা ছবি তুলবো। সে বাহনের আয়নায় চুল ঠিক করে আমার সাথে পোজ দিল। পাঞ্চেত ড্যামের রাস্তা দিয়ে আমরা ঝাড়খন্ড ঢুকলাম। সেখানে একটা স্নেক ক্যাম্প আছে। সেটা ঘুরে আমরা ধানবাদের একটা উষ্ণ প্রস্রবণ ঘুরে আবার পাঞ্চেত ড্যাম দিয়ে ফিরছি। এই ড্যাম না থাকলে দামোদর নদ যে কি ভয়াবহ সেটা এই ড্যামের জল দেখলে বোঝা যায়৷ প্রসংগত পঞ্চকোট সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার নাম ও মহারাজ দামোদর সিং।
 মানিক লাল কে বললাম - দূরের যে ওই পাহাড় দেখছো আমরা সকালে ওই পাহাড়ে উঠেছি।
মানিক লাল বললো - একবার উঠেছেন উঠেছেন, আর উঠবেন না৷ ওখানে ল্যাংরা বাঘ, চিতাবাঘ থাকে৷

  পরে জানলাম পঞ্চকোট পাহাড় ও তার আশেপাশের জংগলে চিতা, পাইথন, বুনো শুয়োর, হায়েনা সবই পাওয়া যায়। গড়পঞ্চকোট মন্দির পৌঁছাতে বিকেল নেমে এলে। ভাঙা মন্দিরগুলো যেন মাথায় একটাই লাইন এনে দিল - সাম্রাজ্যের অস্ত যায় সূর্যের মত। ওখান থেকে ফিরে এসে আমরা ঘুমিয়ে গেলাম। পরেরদিন উঠে আমরা আসানসোল দয়ে ফিরে এলাম। দুদিনে এত বড় জায়গা কতটুকু আর ঘোরা যায়। অনেক কিছুই বাকি থেকে গেল। তাই আবার যেতে হবে গড় পঞ্চকোট। অরণ্যের সংস্পর্শে এসে রাতে ভাবছিলাম আমরা যদি সাফল্যে দুঃখ আর ব্যর্থতাকে সেলিব্রেট করি, তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ পাল্টে যেত৷ মানুষ যুদ্ধ পরবর্তী উল্লাস থেকে যুদ্ধজয়ের প্রেরণা পায়। কত যুদ্ধ এভাবে থেমে যাবে।
যে নেশা করেই এটা ভেবে থাকি, এটা ঠিক পরিবেশ বাঁচানোর উদ্যোগে সবাইকে কম বেশি এগিয়ে আসতে হবে। নাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। শেষ করবো বায়রন দিয়ে -
"There is a pleasure in the pathless woods,/
There is a rapture on the lonely shore,/
There is society, where none intrudes,/
By the deep Sea, and music in its roar:/
I love not Man the less, but Nature more "



























( এই ভ্রমণকাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে ইহার কোন মিল খুঁজিবেন না।) 

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...