Monday, June 19, 2017

Buddha, the enlightened

সকাল হবে হবে করছে , প্লার্টফর্মে ট্রেন থামলো, একটি ছেলে উঠলো ট্রেনে ছুটে এসে। একদম ভোরের প্রথম ট্রেন, ফাঁকা ফাঁকা। একটা কোণে গিয়ে বসে পড়ল সিটে। তার পাশে আর সামনে পেছনে আরো পাঁচজন এসে বসলো। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। হঠাত সাদা কাপড় পড়ে এক মুণ্ডিতমস্তক যুবক লাঠি হাতে উঠল ট্রেনে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ধীরপায়ে এসে সে ওই ছয়জনের পাশেই বসলো।
ট্রেন চলতে লাগল। সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চটিপায়ে ওই সাদা কাপড়ের লোকটির দিকে আড় চোখে দেখছে। শীর্ণকায় শরীর, অতি সাধারণ এক মুখ, চোখ দুটি কোটরস্থ, উজ্জ্বল এবং শান্ত । শারীরী ভাষা এতটাই অন্যরকম শান্ত যে বয়স কম হলেও সম্মান করতে মন জাগে।
কৌতুহল চাপতে না পেরে একজন প্রৌঢ় বলে ফেললো - কেউ মারা গিয়েছে নাকি ?
সাদা কাপড়ের লোকটি উত্তর দিল - হ্যাঁ, অনেকে। আমার সব ঋণাত্মকতা মারা গিয়েছে।
এরকম একটা অদ্ভুত উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তা খুব কৌতুক অনুভব করলো।
উত্তর দিল - তা আপনি কি সাধু ?
উত্তর এল - আমি এমন একজন যে সর্বোচ্চ জ্ঞান লাভ করেছি । পরম সত্যকে জেনেছি। আর সেটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এসেছি। সংসারে মানুষের দু:খ কষ্টের উপশম করতে এসেছি। আমি একজন বুদ্ধ। সাধুও বললে আপত্তি নেই।
'তাই নাকি' এবার প্রথম সেই দাঁড়িওয়ালা যুবক ব্যংগ করে উঠলো।
'তা সাধু আপনি পারবেন আমার সমস্যার সমাধান করতে ? '
উত্তর এল, 'বলুন'
যুবক শুরু করলো।
' আমাকে সবাই কেমো বলেই জানে, হসপিটালে ডাক্তার ছিলাম ক্যান্সার বিভাগে। তারপর আমার একটি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়। প্রচুর কথা হত। মেয়েটির সংগে আমার একটি ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়।তারপর জানতে পারি ও আমাকে প্রতারণা করেছে। আমাকে না জানিয়েই অন্য একটি ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায়। রাগে অপমানে আমি ছটপট করতে থাকি। আমি সেই ছেলেটিকে একদিন আলাদা করে নিয়ে বসি। ছেলেটি আজেবাজে বলায় তাকে খুন করে দিই। আমার জেল হয়ে যায়। জেলে যাওয়ায় আমি চাকরি থেকে বরখাস্ত হই। জেলে ভালো ব্যবহারের জন্য আমি আজ ছাড়া পেয়েছি।কিন্তু রোজ রাতে ছটপট করতাম ছেলেটাকে খুন করেও আমার শান্তি হয়নি। শুনেছি ও আবার বিয়ে করেছে অন্য একজনকে। তাকেও খুন করবো যাচ্ছি। কিন্তু জানিনা শান্তি পাবো কিনা। এর সমাধান কোথায় বলুন। মেয়েটাকে খুন করলে কি শান্তি হবে নাকি নিজেকে ? '
বুদ্ধ স্মিত হেসে তাকালেন তার দিকে। কি অদ্ভুত শান্ত সেই হাসি। একটা সুনামিও স্থির হয়ে যেতে পারে সেই হাসি চোখের রেটিনায় চুম্বন করলে।
- তুমি ওকে ভালোবাসতে ?
- হ্যাঁ।
- কতটা ?
- অনেক। এখন ঘৃণা করি।
- আচ্ছা তুমি কোন ফুল পছন্দ কর ?
- গোলাপ।
- গোলাপ দেখলেই মনে হয় তুলে ওকে দিতে ?
- হ্যাঁ মনে হয়।
- আচ্ছা তুমি কখনো শরতের সকালে শিউলি গাছের তলায় গিয়ে প্রাণ খুলে শ্বাস নিয়েছ ?
- হ্যাঁ নিয়েছি।
- কেমন লেগেছে ?
- খুব ভালো।
- তোমার মনে হয়েছে গাছের সব শিউলি ফুলগুলো তুলে ওর হাতে দিতে ?
- না শিউলির ব্যাপার টা আলাদা। ওকে বরং গাছের তলা থেকে দাঁড়িয়ে আমার মত প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে বলবো।
- শোন তুমি গোলাপ কে পছন্দ কর আর শিউলিকে ভালোবাসো।
- তার মানে কি বলতে চান ?
- ভেবে দেখো, যে তোমার কোনদিন ছিলনা, তোমার আড়ালে অন্যের সাথে সম্পর্ক করেছে সেই ফুলকে ভালোবেসে থাকলে তাকে যে গাছে মানায় সেখানেই থাকতে দিয়ে হাসিমুখে সরে এসো।
- কিন্তু এভাবে চলে যেতে দেওয়া যায় না যাকে ভালোবাসা যায়।
- হ্যাঁ যায় এটাই ভালোবাসা। ওকে ছেড়ে দাও। ফিরে না এলে ও তোমার ছিলোনা কোনদিন। শেষ দিনে কতটা তুমি ভালবেসেছো মানুষকে, কতটা নম্রভাবে জীবন কাটিয়েছ, কতটা ভালোভাবে কাউকে যেতে দিয়েছ যে তোমার জন্য নয়, এটাই শুধু মাথায় থাকবে।
অনেক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাত ধরা গলায় প্রথম যুবক বললো
- কিন্তু আম-মি যে মানুষ খুন করেছি, অনেক বাজে কাজ করেছি।
- যত কঠিন তোমার অতীত হোক, তুমি আবার নতুন শুরু করতে পারো।
- আমি কিভাবে শান্তি পেতে পাবো। ও আমাকে শান্তি দিত।
- ও নয়, শান্তি একমাত্র তুমিই নিজেকে দিতে পারো। বাইরের কেউ নয়।
- কিন্তু সাধু আমি অনেক খারাপ কাজ করেছি। ও আমায় ছেড়ে যাওয়ার সময়, আমি মেয়েদের প্রতি ঘৃণা থেকে অনেকের সাথে ফ্লার্ট করতাম। এর মধ্যে অনেকে নিশ্চয়ই ভালো ছিল। ওদের কে বন্ধু বলতাম। বেশি কিছু দাবী করলে ঝেড়ে দিতাম। আমাকে তো ওরা খুব ঘৃণা করে এখন।
- বেশ তো। সবার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিও। এতে যদি শান্তি পাও। কেউ তোমার সাথে খারাপ কিছু করলে তাকেও ক্ষমা করে দিও। কখনো দেখোনি সকালের আলো কিভাবে জানালার ফাঁক চিরে প্রবেশ করে। ঠিক সেভাবে আঘাত পেলে সেই স্থান দিয়ে আলো প্রবেশ করে যদি তুমি চাও।
- আপনি কি করে ক্ষমা করেন যারা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করে ?
- হয়তো তারা ভুল করে, হয়তো তারা আমায় ভুল বুঝে করে। যাই করুক, আমি জানিনা তারা কি পরিস্থিতিতে করে। সবাই যে যার পরিস্থিতির স্বীকার। ক্ষমা করতে গেলে বুঝতে শিখতে হবে। বুঝতে গেলে ক্ষমা করতে জানতে হবে। তুমি জানোনা তার পরিস্থিতিতে তুমি কি করতে। তার মধ্যেও রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ সব আছে। রাগ মানুষের বুদ্ধিনাশ করে। সে সেটাই ভাবে যেটা সেই সময় তার পরিস্থিতি আর অভিজ্ঞতা ভাবতে বাধ্য করে। কাউকে ক্ষমা না করলে শান্তি পাবেনা। একমাত্র আলো পারে অন্ধকার কে দূর করতে। অন্ধকার পারেনা। তাই কাউকে সহজে বিচার কোরোনা। তুমি কেউ নও বিচার করার।
- রাগ কে বশ করার উপায় কি ?
- তার ক্ষতি করা খুব কঠিন যে কিছুই চায়না, শুধু ভালোবাসতে জানে। পৃথিবীর সব যুদ্ধ জয় করার থেকে নিজেকে জয় করা বড় জয়। মানুষের মন নিজেই নিজের সব থেকে বড় শত্রু আর সব থেকে বড় বন্ধু । তুমি কে পুরোটাই নির্ভর করছে তুমি কি ভাবছ তার উপর। নিজেকে জয় করতে পারলেই তুমি বুদ্ধ। প্রকৃত
জ্ঞানী। অনেক জন্মের অনেক ধাক্কা, যন্ত্রণা অভিজ্ঞতা আর সাধনা মানুষকে সেই জায়গায় নিয়ে যায়। আমি বলবো তুমি নিজেই সেই পথ খোঁজো । প্রকৃত জ্ঞানের পথ। হাজারটা বড় কথার থেকে একটু সাধনা সেই পথকে ত্বরাণ্বিত করে।
- সবাই যদি প্রকৃত জ্ঞানী হয়, তাহলে তো আর কেউ সংসার করবে না ।
- কেন সেটা হবে। বরং লোকে আরো শান্তিতে সংসার করবে।
- কেন ? আপনার পথ তো সন্ন্যাসের পথ।
- সংসারে জ্ঞানীর মত বেঁচে থাকাও তো একরকম সন্ন্যাস। হিমালয়ের কোলেও ফুল ফোটে।বাড়ির দালানেও। দুটোই সুন্দর। কখনো যদি কোন ফুল আর শিশুর দর্শন তুমি বুঝে থাকো তাহলে তোমার পৃথিবী অনেক শান্তিময় আর সুন্দর হয়ে উঠবে।
- কিন্তু যারা আমাকে ভুলে বুঝেছে তাদের আমি কি করে বোঝাবো, যে আমি পাল্টাতে চাই নিজেকে। যারা অপমান করেছে, আমাকে নিয়ে খেলেছে, মুখে একরকম বলে কাজের বেলায় যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের ক্ষমা করে লাভ ?
- ক্ষমা করলে শান্তি পাবে। শান্তি পেলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর লাগবে। প্রাণ খুলে শ্বাস নেবে। হাসবে। যে যা করেছে, তাদের ক্ষমা করে দিও। এগিয়ে যাও সামনের দিকে। তারা কেউ আবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে সত্যি ফিরে আসতে চাইছে এরকম মনে হলে ইচ্ছে হলে ফিরিয়ে নিও। নাহলে বুঝিয়ে দিও তুমি ফেরাতে চাওনা। সবাইকে ফেরানোও তোমার দায় নয়। এই পৃথিবীতে তোমার স্নেহ ভালোবাসা র সব থেকে বেশি দরকার তোমার নিজের। কাউকে আবার ফেরাতে গিয়ে নিশ্চিত থেকো সে আবার তোমায় অপমান করবেনা। কেউ না এলে একাই হেঁটে যেও। যে ঠিক বোঝার ঠিক সময় হলে বুঝে নেবে। সেটা তোমার দায় নয়। একটা কথা মাথায় রেখো, আমি বলছি বলে নয়, তোমার রাস্তা তোমাকেই হাঁটতে হবে। একাই।
ট্রেনটা থামলো। বুদ্ধর সম্মোহনী শক্তিতে সবাই তখন বশীভূত। বুদ্ধ ধীর গতিতে নেমে গেলেন। তার সাথে সেই ব্যংগ কর্তাও। বুদ্ধ প্লার্টফর্মে নেমে জানতে চাইলেন - কি ব্যাপার ? এখানে নামলে ?
লোকটি হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল একজন শীর্ণকায় সাধারণ চেহারার শ্বেত বস্ত্র ধারী যুবকের সামনে।
- আমি আপনার সাথে থাকতে চাই।
বুদ্ধ হেসে তার মাথায় হাত দিলেন। সকালের আলো তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...