Wednesday, November 20, 2019

সংগীত- ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

"বলছে চুড়ি, বলছে কংকণ/
হায়রে হয়ে গেলাম তোর সাজন.. "
এইটা হল খুব হিট একটা হিন্দী গান "বোলে চুড়িয়া" র ভাষা। শুধু এটা নয়, আরো অনেক উদাহরণ আছে৷ এটা থেকে কয়েকটা সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে -
১) সংগীত এ লিরিক্স এর গুরুত্ব নেই। এমন নয় যে ভালো লিরিক্স থাকলে গান হিট করতে পারেনা। ভালো লিরিক্স হল মাধ্যমিকের এডিশনাল সাবজেক্ট এর মত৷ যদি তা না হত, টুনির মা থেকে বিঠোফেন, মোত্জার্ট কারোর সৃষ্টি হিট হতনা। এরকম ও অনেক গান আছে যেগুলো হিট বিশেষত তার তালের জন্য। যেমন গ্যাংনাম স্টাইল, কোলাভেরি ডি৷ তাই হিট হতে গেলে সুর বা তাল অথবা দুটো অবশ্যই আকর্ষক হতে হবে৷
২) জনতা কিছু বোঝেনা। এই পয়েন্ট টা আমি পুরোপুরি সহমত নই। পুরোপুরি কথাটা বললাম কারণ 'এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়' আর 'উঠোগো ভারত লক্ষ্মী' এই দুটোরই শুরু একইরকম সুরে। যদিও দুটো গানের এম্বিয়েন্স আলাদা। আবার "কিচ্ছু চাইনি আমি" আর "তোমাকে বুঝিনা প্রিয়" দুটো গানেরই শুরুর সুর একইরকম। অথচ দুটোই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে হিট। সহমত নই কথাটা বললাম কারণ জনতা কিছু না বুঝলে আমি কোনরকম ট্যাগ ছাড়া আমার গানের এক লাখ শ্রোতা পেতাম না। 'অপরাধী', 'চলে গেছো তাতে কি ' গানগুলো কোনরকম ট্যাগ ছাড়া হিট করতো না।
সে যাই হোক, আজ আমি কয়েকটা পিলার ছুঁয়ে অতি সংক্ষেপে আগামী দিনের সংগীত কিরকম দিকে যেতে চলেছে সেটা নিয়ে আমার বিশ্লেষণ লিখবো। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই গলার কন্ঠ, গলা খাঁকারি, হাঁচি ইত্যাদি দিয়ে মিউজিক তৈরির প্রবণতা দেখা যায়। নিজের সাথীদের বিপদ সংকেত দেওয়ার জন্য এক ধরনের মিউজিক ব্যবহার করতো আদিম মানুষেরা। সংগীত কে কমিউনিকেশনের মাধ্যম হিসেবে ধরলে মানুষ কথা বলতে শেখার আগেই মিউজিকের ব্যবহার শিখেছে বলে আমার ধারণা। কারণ শব্দ সাজিয়ে কথা বলতে গেলে একটা ভাষার মোটামুটি একটা ব্যকরণ তৈরি করতে হবে। আমি একটা লেখার জন্য নতুন এক ভাষা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিলাম, সেটা করতে গিয়ে বুঝেছি এই কাজটি কতটা কঠিন৷ যাই হোক, পৃথিবীর প্রাচীনতম মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ধরা হয়, নিয়েন্ডারথাল দের দ্বারা প্রস্তুত গুহাভাল্লুক এর উরুর হাড় ( খুব সম্ভবত ফিমার) দিয়ে তৈরি এক বাঁশি। তারপর একসময় মানুষ একটু একটু লিখতে শিখল। ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীত এর ভিত্তি ধরা হয় সামবেদ এর মধ্যে। বিভিন্ন মন্ত্র বিশেষ সুরে পড়া হত৷ এই সময়কালের বিভিন্ন স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্ট ও বাঁশি প্রজাতির যন্ত্র ও পাওয়া যায়। "রাবণ হাথা" নামের একধরণের বেহালা কে ধরা হয় বিশ্বের প্রাচীনতম স্বীকৃত স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্ট গুলোর মধ্যে একটা৷ তারপর মানুষ লিখতে শেখার পর সংগীত এ আরো পারদর্শী হয়ে ওঠে। ভারত, ইরান, গ্রীস, মিশর ছাড়িয়ে মিউজিক কে আপন করে রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলি। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক এর সূত্রপাত ঘটে চার্চ এর হাত ধরে৷ এর সাথে ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সংগীত এর একটা মিল পাওয়া যায়৷ কারণ ভারতেও সামবেদ থেকে শুরু করে ক্লাসিক্যাল সংগীত (বিশেষত দক্ষিণ ভারতের রাগ) মূলত ভগবান কে নিবেদন করে ভক্তিভাবে ৷ ভারতের প্রাচীন ক্লাসিক্যাল মিউজিক নিয়ে যা কিছু লেখালেখি বেশিরভাগ হয়েছে একাদশ থেকে ষোড়শ শতকের ( খ্রীস্টাব্দে) মধ্যে। এইসময় তানসেন, বৈজু বাওরা ছিলেন। তারপরেই লোকসংগীত এর সূত্রপাত হল। এই লোকসংগীত এর মধ্যে জনপ্রিয় বাউল, ভাটিয়ালি, ভজন, কীর্তন বেশিরভাগই ভক্তিমূলক। ইউরোপে এলেন মোজার্ট, বিঠোফেন, স্কুবার্ট৷ সংগীত এর যে পৃথিবী জুড়ে ধীর স্থির ভাব সেটা মানুষের মনস্তত্ত্ব এর সাথে বদলাতে লাগলো ধীরে ধীরে৷ বেতার প্রযুক্তি আসার পর সংগীত এ শ্রোতা বাড়ল। সংগীত এর ধারা ভগবান থেকে ধীরে ধীরে প্রকৃতি, প্রেম ইত্যাদির দিকে বেশি করে ফ্লাশলাইট ফেললো। বিশ শতকের মধ্যভাগ শেষ হতেই ফ্লাশলাইট গিয়ে পড়ল রক ও পপ সংগীতের উপর৷ ভারতে এর প্রভাব আসতে দেরী হয়েছে কিছুটা৷ পাশ্চাত্যের তত্কালীন মনস্তত্ত্বকে প্রতিফলিত করে এই রক মিউজিক। ভারতে তখন শচীন দেব বর্মণ, শংকর-জয়কিষণ , সলিল, সুধীন ইত্যাদি চলছে। মেলোডি গানে থাবা বসালো রক একেবারে বিশ শতকের শেষে গিয়ে । কারণ ভারতীয়দের মন ও চাইছিল এরকম কিছু যা সব দুশ্চিন্তা গুলোকে এলোমেলো করে দেবে। একুশ শতকে সামগান এর জন্ম যে ভূখন্ডে সেই দেশে রক ও পপ উপনিবেশ স্থাপন করলো। শুধু যদি ভারতে ধরি এখন মূলত পপ, রক, ইলেকট্রনিক মিউজিক, লোকগীতি ও কিছুটা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক লোকে শোনে৷ ইলেকট্রিক গিটারে যে অদ্ভুত শক্তিশালী শব্দ আসে, সেটা আনপ্লাগড্ এ আসে একটা ছোট টুং শব্দ হয়ে৷ গিটারিস্ট সেই প্রচন্ড শব্দ টাকে অভিনয় করে দেখায়, যেন খুব জোরে গিটার স্ট্রাম করছেন৷ অনেক ব্যান্ড ই লাইভ যখন করে অরিজিনালি গায়না বা বাজায়না, রেকর্ড থেকে বাজে বা পেছনে কেউ বাজায়৷ তারা স্টেজে ওঠে শুধু অভিনয় করতে৷ অর্থাৎ সংগীতে এখন অভিনয় ভীষণ ভাবে এসে পড়েছে৷ একুশ শতকে অডিও-ভিসুয়্যাল যুগে এখন ভিডিও বা সিনেমা র গান ছাড়া শুধু গান হিসেবে রিলিজ করে কটা হিট ( হিট মানে ভিউ বা শ্রোতার সংখ্যা দিয়ে নয়, লোকের মুখে মুখে ফেরে এরকম) করেছে গুণে বলা যাবে। একটা কথাই আছে- মিউজিক এখন আর লোকে শোনেনা, দেখে। এবার যারা লোকগীতি করে, ফ্রি ল্যান্সিং করে তারা ভিডিও বানানোর টাকা পাবে কোথায়? আপনি বলবেন, কি দরকার বানানোর তাদের? এটা তো কোন কথা নয়৷ সেরকম ভাবলে তো মহাভারতের পর আর কারো কিছু লেখা উচিত নয়। রবীন্দ্রনাথের পর কারো প্রেম নিয়ে কিছু লেখা উচিত নয়৷ আর্ট এভাবে থেমে থাকে নাকি? এখন, বেডসিন থাকলে গানের মিলিয়ন ভিউ বাঁধা। এই জায়গা থেকেই রাগে একটা গান লিখেছিলাম। কিন্তু বাস্তব কে আমাদের, মিউজিশিয়ানদের মেনে নিতেই হবে।
আর এসেছে এডিটিং৷ কজন সেলেব খালি গলায় লাইভ গান গাইতে রাজি হবেন খুব সন্দেহ আছে । যাই হোক, সব আধুনিকতা কেই স্বাগত জানাই৷ কিন্তু আধুনিক হতে গিয়ে আমরা যেন ইতিহাসকে ভুলে না যাই৷ আমার ধারণা ভবিষ্যতে ভারতীয় সংগীতে পুরোপুরি ভাবে থাবা বসাবে অডিও ভিসুয়্যাল ইলেকট্রনিক মিউজিক। র‍্যাপ প্রাধান্য পাবে লিরিক্সে। মানুষের শোনার ধৈর্য কমে গেছে, বোঝার সময় নেই। ব্যস্ত এই মানুষের মনস্তত্ত্বকে পরিচালিত করছে তার মাথায় চলতে থাকা ক্যাওস। তার সাথে সোশ্যাল মিডিয়াতে নার্সিসিজম্ এর রমরমা বাজারে অতি অল্প এ খ্যাতি পাওয়ার লোভ থেকে মিউজিশিয়ানরাও এই দিকেই ঝুঁকবে। ইলেকট্রনিক মিউজিক সুর ও তাল এর একদম বেসিক কনসেপ্ট থাকলে আর সফ্টওয়ার হ্যান্ডেল করতে পারলে, কিছু টাকা খরচ করলেই হাতের মুঠোয়। প্র‍্যাকটিস লাগেনা। তাই ইলেকট্রনিক রক যে প্রাধান্য পাবে আগামী দিনে, সেটা আমার ধারণা। সোজা কথায়, মিউজিকে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার রা রাজত্ব করবেন।
তবে এটাও বিশ্বাস লোকগীতি, ক্লাসিক্যাল মিউজিক হারিয়ে যাবেনা পুরোপুরি। শ্যামল মিত্র, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত দের সুর মনের ভিতরে থেকে যাবে।
সবার শেষে বলি, একজন সামান্য মিউজিশিয়ান হিসেবে যেটুকু জ্ঞান, তাই নিয়ে আমার এই বিশ্লেষণ। এই স্বল্প জ্ঞান নিয়ে লেখাতে কারো ভাবাবেগে আঘাত লাগলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী বা কোন ভুল চোখে পড়লে আমাকে মারবেন না৷ আমি ইতিহাসবিদ নই। শেষ করবো উত্তর পূর্ব ভারতের কংথং গ্রাম এর কথা বলে৷ এই গ্রামের কোন মানুষের নাম ধরে ডাকা হয়না। কারণ নাম দেওয়ার সময় সবাইকে একটা করে মৌলিক সুর দেওয়া হয়, সেটাই তাদের নাম৷ সেই সুরেই তাদের ডাকা হয়। মিউজিক হল পৃথিবীর প্রাচীনতম শিল্পগুলোর মধ্যে একটা। একটি সদ্যজাত শিশুর প্রথম কান্নার মধ্যেও মিউজিক রয়েছে। অর্থাৎ আমরা অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে সবাই মিউজিশিয়ান। এটাও বলা যেতে পারে মিউজিক হল একাধারে সব থেকে সহজ ও সব থেকে কঠিন আর্ট ।।

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...