Sunday, January 30, 2022

দ্বিতীয় অধ্যায়

যে ছেলে বা মেয়েটি আজ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে, তারা এই ভরসাটুকু থেকেই হচ্ছে যে একে অপরের কাছে সুখ, শান্তি, পারস্পরিক সম্মান রেখে জীবন কাটাবে একসাথে । আসলে কি সবসময় তাই হয়?

সুখ ভালোবাসা থেকে আসে। ভালোবাসা আসে ভালো ভাষা থেকে। আসলে কি তা হয়?
শান্তি পেতে দুজনকে একসাথে অশান্ত হতে নেই। আসলে কি তা হয়?
পারস্পরিক সম্মান!? থাক্। আর বললাম্ না।
একটা সময় পরে একটা পক্ষ বুঝেই যায়, তার পক্ষে অন্য পক্ষের মত অসম্মান বা দোষারোপে অংশগ্রহণ করার এত শক্তি নেই। তাই সে চুপ করে যায়। সে চুপ করে গেলে অন্য পক্ষ আরো গলার আওয়াজ বাড়ায়। এতে ভালোবাসা বাড়ে কিনা জানা নেই,তবে দুজনের মানসিক দূরত্ব বাড়ে। একদিন সুতো কেটে যায়।

এক্ষেত্রে এক অদ্ভুত প্যারাডক্স দেখা যায়, এরেঞ্জড ম্যারেজ এর ক্ষেত্রে ডিভোর্স এর রেট কম হয়৷ আবার ভালোবেসে বিয়ে করাতে স্ট্যাট খুব খারাপ। এরেঞ্জড বনাম লাভ ম্যারেজ নয়, আমার এখানেই আজকের লেখা যে কেন? কেন যে দুজন মানুষ ভালোবেসে জীবন কাটাতে চায় তাদের বিবাহের কয়েক বছর পর একে অপরের নিঃশ্বাসকেও বিষাক্ত মনে হয়। আমি কোন পক্ষকে দোষ না দিয়ে লিবারেল একটি আলোচনামূলক লেখা লিখবো। না বেশি গভীর কথা লেখা আমার সাজেনা, আমি তাই প্র‍্যাকটিকাল পয়েন্ট গুলোই তুলে ধরবো। কাউন্টার করে গালাগাল দিলেও যুক্তি দিয়ে দিলে ভালো লাগে।

এটা খুবই স্বাভাবিক একটা সম্পর্কে একটা সময় পর দৈনন্দিন কথার বাইরে আর কোন কথা থাকেনা। কিন্তু তার পরেও কথা তৈরি করা যায়, দুজনের যদি চারিত্রিক মিল থাকে। যেমন একজন বই পড়তে ভালোবাসে, আর একজন অন্যদের জীবন নিয়ে বিশ্লেষণ করতে । দুটো চাওয়ার কোনটাই অপরাধ নয়। কিন্তু প্রথম কথা, এই দুজনের ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ানো খুব অস্বাভাবিক, যদি দুজনে বিয়ের আগে নিজেদেরকে স্পষ্ট ভাবে একে অপরের কাছে উপস্থাপন করে। এখানেই হয়ে যায় গন্ডগোল। বিয়ের আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একে অপরের কাছে স্পষ্টভাবে নিজের আসল রূপ উপস্থাপন করেনা কেউই৷ না ভেতরের, না বাইরের। অনেক ধরনের কমবেশি লুকোচুরি, মিথ্যে দিয়ে চলে দু পক্ষই। এক্ষেত্রে এটা যত কম হয় দুপক্ষ থেকেই পরবর্তীকালে সম্পর্কের সচলীকরণ অনেক ভালো হয়। তাহলে হঠাৎ একদিন একটা একলা বিছানায় ঘুম ভেঙে মাঝরাতে উঠে দেখতে হয়না দুচোখে নিঃশব্দে চোখের জল। উঠতে চাইছে সে বিছানা থেকে। নিকষ কালো অন্ধকার যেন তার সারা শরীরে বেড়ি পড়িয়ে রেখেছে। বলতে চাইছে সে কাউকে। কিন্তু এরকম লিবারেল পরিবার কটা হয়। এরকম দিন কাউকেই দেখতে হয়না যদি পূর্বরাগের সময়ে মানুষটা একা থাকলে কি করতে পছন্দ করে, সে কিভাবে একটা গান বা সাহিত্যের বিচার করে বা আদৌ করে কিনা, সে সমাজকে কতটা গুরুত্ব দেয়, যেটুকু গুরুত্ব দেয় সেটার জন্য সে কিরকম ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার স্বপ্ন কি, ভালো লাগা কি, সে কিভাবে পছন্দ করে নিজের রাগের সময় তাকে কেউ মানাক ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। একে অপরের পছন্দের তালিকার ভিত্তিতে যাদের সাথে সব থেকে বেশি মিল বা মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেই তাদের সাথেই সম্পর্কে এগোনো উচিৎ। একজন হয়তো কবিতা লিখতে পছন্দ করে একা নিঃশব্দে, আর একজন লাউডস্পিকারে গান চালিয়ে কাজ করতে। দুজনে একসাথে কখনোই শান্তিতে থাকতে পারেনা৷ বিজ্ঞানে কারণ ভিত্তিক এফেক্ট হয়। আমরা এফেক্ট নিয়ে মূলতঃ পরিচিত মহলে অপর পক্ষকে দোষ দিয়ে থাকি। মনটা খচখচ করে অপর পক্ষ থেকে শানানো প্রত্যেকটা দোষের তীরের জবাব পকেটে লুকিয়ে রাখা পরমাণু বোমাতে দিতে। কিন্তু এতে শুধু পৃথিবী ধ্বংস হবে। কেন এক পক্ষ করলে একটা কাজ ঠিক, কেন অন্য পক্ষ করলে সেটা ভুল এসব প্রশ্নের জবাব নিয়ে হবে টাই বা কি?
দোষ বিচার করার আমি আপনি কে? কে ঠিক, কে ভুল এসব বিচার কে করবে, কেন করবে, করেই বা কি হবে?
"Why just the sun go on shining
Why just the sea rush to shore
Don't they know it's the end of the world
'Cause you don't love me any more"

এফেক্ট যা হওয়ার হয়ে গেছে। যেটা পূর্বরাগে করা উচিত ছিল বা করিয়ে নেওয়া উচিত ছিল, সেটা দুজনের দুজনেই বা কেউ একজন করেনি। এটাই কারণ। সেটা নিয়েই আলোচনা। আমার পাঠক মহলে অনেকেই অবিবাহিত। তাদের সবার উদ্দেশ্যে একটাই কথা। ভালোবাসা আর বিবাহ এক নয়। লাভ ম্যারেজে ডিভোর্স রেট বেশি, কারণ তাদের একে অপরের উপর যেটুকু সম্মান বেঁচে থাকে তারা বুঝতে পারে তারা একে অপরের জন্য নয়। তাই বেশি। তার সাথে এই তথ্য ও দেওয়া দরকার এরেন্জড ম্যারেজে কত শতাংশ ঘরে ম্যারিটাল রেপ হয়। ডিভোর্স নিয়ে ছুত্ মার্গ থাকার কারণে সেক্ষত্রে কোন এক পক্ষ পিছিয়ে আসে। যেকোন সম্পর্কে একটি ছেলের প্রধান ন্যূনতম চাহিদা শান্তি ও সম্মান। একটি মেয়ের প্রধান চাহিদা বলে কিছু হয়না। তারা একটু ভালো থাকতে চায়। অনেক সময় কোন এক পক্ষ জানেই না তারা কিভাবে ভালো থাকবে? তারা জানেওনা তাদের পছন্দ কি? আজকের এই মেশিন বেসড্ পৃথিবীতে যেখানে ভাবার সময় খুব কম, সেখানে এটা খুব স্বাভাবিক।
একজন যে পড়তে ভালোবাসে, তার সেরকম মানুষের সাথেই বিয়ে করা উচিৎ। তাতে যখন তাদের কথা বলা ফুরোবে, তখন তারা বিভিন্ন নতুন বই পড়ে তার মাধ্যমে একে অপরকে নতুন ভাবে চিনবে। যার সিরিয়াল দেখতে ভালো লাগে, তার সেরকম মানুষের সাথেই জীবন কাটানো উচিৎ। আর আমার ব্যক্তিগত মতামত, একজন প্রতিভাবান শিল্পী বা বিজ্ঞানী বা জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তির বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের দিকে যাওয়াই উচিৎ না। সখের কাজ আলাদা। যে সারাদিন পৃথিবীর সব কিছু ভুলে কাজ নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসে, তার জন্য বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি নয় বলেই আমি মনে করি। তারা একা থাকার জন্য জন্মায়। কারণ সে এভাবেই এসেছে, এভাবেই চলে যাবে। এই সত্যিটা তারা না বুঝে ঝাঁপ দিলে পুড়তে তো হবেই। এদেরকে মানুষ সহজে ভালোবাসে, কিন্তু কাউকে ভালোবাসলে তো গোটা ব্যাপারটাকে ভালোবাসতে হয়। সেটা হয়না। সম্ভব নয়। তাই এই দহন।
না পুড়লে খাঁটি সোনা কি করে হবে? সূর্যের মত হতে চাইলে তো সূর্যের মত পুড়তে হবে।

উপরে যতরকম ইচ্ছে বা প্রবৃত্তির কথা বললাম একটিও অপরাধ বা খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবুও যদি কারও সূক্ষ্ম অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকি আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

কিছু মানুষ বরং পৃথিবীর দ্বিতীয় অধ্যায়টাই লিখুক। বিবাহ, সংসার, ভালোবাসা এইসব প্রথম অধ্যায়টা ছেড়ে রাখা হোক্, পৃথিবীর অন্য মানুষগুলোর জন্য।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুই হোক্ রবীন্দ্রনাথ এর লাইন দিয়ে -
" সখী,    ভাবনা কাহারে বলে।   সখী,    যাতনা কাহারে বলে ।

        তোমরা যে বলো দিবস-রজনী    ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—


        সখী,    ভালোবাসা কারে কয়!  সে কি   কেবলই যাতনাময় ।


        সে কি   কেবলই চোখের জল?   সে কি   কেবলই দুখের শ্বাস ?


        লোকে তবে করে   কী সুখেরই তরে   এমন দুখের আশ ।


                  আমার চোখে তো সকলই শোভন,


        সকলই নবীন, সকলই বিমল,    সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,


        বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো ।


        তারা  কেবলই হাসে, কেবলই গায়,   হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—


        না জানে বেদন, না জানে রোদন,   না জানে সাধের যাতনা যত । "

দ্বিতীয় অধ্যায়ের এই ভালোবাসায় কান্না নেই, যাতনা নেই। এটা সবার প্রতি। সামগ্রিক চেতনার প্রতি উজাড় করে দেওয়া ভালোবাসায় কোন ঋণাত্মকতা থাকেনা। পাখিকে ছেড়ে দাও মুক্ত আকাশে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডুব দিলে এ জীবনের সব মোহকেই মিথ্যে মনে হবে। অপরের সব অপরাধকে ক্ষমা করে এগিয়ে চলার সাহস পাওয়া যাবে। একদিন দুচোখের জল শুকাবে। আকাশের মেঘ সারা জীবন অন্ধকার করে থাকতে পারেনা। তখন এটাই বোঝার, দুটো সমান্তরাল বিশ্বের মানুষ একসাথে থাকলে স্পেস- টাইম কন্টিনিউয়ামের বিকৃতি ঘটা খুব স্বাভাবিক। এখানে কাউকে দোষ দিয়ে হবেটাই বা কি? কেই বা বুঝবে? কেনই বা বুঝবে? নিজেকে এতটাই ভালোবাসতে হবে রাধার মতো, যে নিজের অবচেতনে যে রাগে সেতার বাজছে, স্ট্রিং থিওরির সুরে সে সেই কৃষ্ণের বাঁশির সুর শুনতে পাবে। দুটো সুরের হারমনিতে এক অনুরণন হবে। এমন উচ্চতায় থুতু পৌছাবেনা।এ সাধনা একার।।

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...