তখন বেশ কিছুদিন হল কোন লেখা বেরোচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আমার লেখালেখিতে বিকশিত হওয়ার আগেই অবসর নেওয়ার সময় এসেছে। কোন এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে যেন লেখাতো - আজ সেই শক্তি যেন ঘুমন্ত রাজকন্যে হয়ে সমুদ্রের নীচে কফিনে শান্তির ঘুম দিচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের চাপ ও চাকরির একঘেয়েমি যেন দৈত্য হয়ে পাহারা দিচ্ছে তাকে। সেখানে সোনার কাঠি হয়ে রাজকন্যের পা ছুঁয়ে তাকে ঘুম থেকে কিভাবে জাগানো যায়? কারণ তাকে ছাড়া জীবনে যে ধূসর মরুভূমি। উপায় খুঁজতে খুঁজতে মাথায় এল দার্জিলিং ঘুরে আসা যাক। দার্জিলিং কে "কুইন অফ্ হিলস্" বলে। এক রাজকন্যে যদি আরেকজনকে জাগাতে পারে। আমার জীবনে তিনরাত ও দুদিনের ফাঁকা সময় দেখে সেইভাবে প্ল্যান করলাম। মাত্র এক সপ্তাহে দার্জিলিং প্ল্যান করতে গেলে ট্রেন বা ফ্লাইটের আশা না করাই ভালো। তার জন্য অন্তত এক মাস আগে থেকে প্ল্যান করতে হয়। এক-দু মাস আগে থেকে যারা প্ল্যান করে তারা ট্রাভেলার, সাইট সিইং টুরিস্ট। আমি স্বঘোষিত "হন্টক" এক্সপ্লোরার। আমার মাথায় আসা মানে করে ফেলতেই হবে। নাহলে পোকা নামবেনা। রেডবাস থেকে শিলিগুড়ির বাসে যাওয়া আসার টিকিট আর মেকমাইট্রিপ থেকে দার্জিলিং এ হোটেল বুক করে সন্ধ্যে ছটার বাসে বেরিয়ে পড়লাম। স্লিপার ভলভো বাসে খুব বেশি অসুবিধে হয়নি। শুধুমাত্র বাথরুম ছাড়া। ওটা একটু রটিন মেনে খাওয়া ও জল খেলে মাঝে মাঝে বাস যেখানে থামছিল সেখানে সেরে নেওয়া কোন ব্যাপার ছিলনা। পরেরদিন সকাল সাত টায় শিলিগুড়িতে নেমে শেয়ার ট্রেকারে করে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। গ্রুপে না গেলে, শেয়ার ট্রেকারে যাওয়াটা অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই লাভজনক। দার্জিলিং এ নামতেই মেঘের আড়ালে দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেল। হঠাৎ করে দেখলে ভুল করে মেঘ বলেই মনে হতে পারে। যাই হোক, আমি ভোজন রসিক মানুষ। হোটেলে না ঢুকে চলে এলাম কেভেন্টার্স এ। কেভেন্টার্স এ একটা পর্ক ডিশ আর একটা পর্ক বার্গার পেটে ফেলে হোটেলে জিনিসপত্র রেখেই আবার বেরিয়ে পড়লাম হিমালয়ান জু র উদ্দেশ্যে। কাল সন্ধ্যে ছটায় শিলিগুড়ি র বাস। তাই বিশ্রামের কোন গল্প নেই। সাধারণত টুরিস্টরা ভাড়া গাড়িতে সাইট ভিজিট করেন। আমি গুগল ম্যাপে দেখলাম হোটেল থেকে দু কিমি মত দূরত্ব - ভাবলাম পায়ে হেঁটেই মেরে দেবো। কিন্তু দার্জিলিং এর উচ্চতা দু হাজার মিটারের বেশি। বাতাসের ঘনত্ব স্বাভাবিকভাবেই সমতলের থেকে একটু কম। রাস্তাও চড়াই-উতরাই। তাই হাঁটতে একটু কষ্টই হচ্ছিল। যাই হোক, আমার মতে কষ্ট হলেও দার্জিলিং এর রাজকীয় অনুভূতি পেতে গেলে একা হেঁটে বেড়ানোর মূল্য আলাদা। চারিদিকে ওক, শাল, সেগুন এর জঙ্গল দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম চিড়িয়াখানায়। সেখানে ঢুকেই ডান দিকে কালো ভাল্লুকের দর্শন পেলাম। তবে ডান দিকে না গিয়ে প্রথমে একদম বাম দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। নানা জাতের ভেড়া, হরিণ বামদিকে দেখতে দেখতে উপরে উঠছিলাম। রাস্তায় তাকালে দেখলাম কতটা উঠলে কত কিলোক্যালোরি খরচ হচ্ছে লেখা রয়েছে। কারো ক্লান্ত লাগলে বসার জায়গা রয়েছে। রয়েছে স্ন্যাক্স বা আইসক্রিমের দোকান। রাস্তার চড়াই পেরিয়ে দেখলাম হিমালয়ান মাউন্টেরিং ইন্সটিটিউট ও মিউজিয়াম। বিভিন্ন শেরপা ও তাদের বিভিন্ন কালজয়ী শৃঙ্গজয়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র মিউজিয়ামে সাজানো। ইন্সটিটিউট এ নানারকম এক্টিভিটি করা যায়। আমার হাতে সময় কম ছিল। তাই আবার সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। ডানদিকে পেলাম ব্ল্যাক প্যান্থার, স্নো লিওপার্ড, উলফ্, আর বামদিকে পেলাম রাজা রয়াল বেঙ্গল টাইগারকে। সিঁড়ি বেয়ে মূল গেটের কাছে নেমে এসে আবার আর একটা চড়াই রাস্তায় উঠে রেড পান্ডা, বিভিন্ন পাখি, বানর, বিড়াল ইত্যাদি দেখে বেরিয়ে এলাম। চিড়িয়াখানা থেকে ফেরার পথে নাইটিঙ্গল পার্কে ঢুঁ মেরে এলাম। এটি নানারকম গাছ, ফুল দিয়ে সাজানো একটি পার্ক। এখান থেকে নীচের উপত্যকার একটা ভিউ পয়েন্ট পাওয়া যায়। প্রবেশ মূল্য রয়েছে। চিড়িয়াখানা যতটা সাজানো ও গোছানো, এটি ততটা নয়। এরপর ফেরার পথে আমি যে রাস্তায় ফিরেছিলাম সেখান থেকে বেঁকে অবজার্ভেটরি হিল ভিউ পয়েন্টে পৌঁছলাম। সেখান থেকে পাহাড় ও তার সংলগ্ন উপত্যকার দারুণ দর্শন পাওয়া যায়। গুগুল ম্যাপে দেখলাম এখান দিয়ে একটি রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে মল মার্কেটের দিকে গিয়েছে। অজানা রাস্তা। এটাই তো চাই। হাঁটা শুরু করলাম। পথে একটি শিব মন্দির (মহাকাল মন্দির); ও আরো দুটি ভিউ পয়েন্ট পেলাম। অবশেষে সন্ধ্যে ৫.৩০ টা নাগাদ মল মার্কেটের চৌরাস্তায় পৌঁছলাম। এটি একটি সমতল জায়গা। সেখানেই কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। এর চারিদিকে উতরাই রাস্তা দিয়ে বাজার ও রেস্তোরাঁয় সাজানো রাস্তা নেমে গেছে। সেরকম একটি রাস্তা দিয়ে নেমে পেলাম গ্লেনেরিস এর সন্ধান। তার কাছেই একটি রেস্তোরাঁয় মোমো খেলাম। ফেরার পথে একবার গ্লেনেরিস এ ঢুঁ মেরে হোটেলের বিছানায় শরীর ফেলতেই ক্লান্তিতে ঘুম চলে এল। যেরকম কুয়াশা ছিল আমি নিশ্চিত ছিলাম টাইগার হিলে মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সৌভাগ্য আমার হবেনা। পরের দিন তাই একটু দেরী করে সকাল ছটায় উঠে পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম বুদ্ধিস্ট পিস প্যাগোডা র দিকে। এটি মল মার্কেট ও চিড়িয়াখানার উলটো পথে পড়ে। সকালের ফাঁকা গান্ধী রোড দিয়ে লাল কোঠি রোডের চড়াই উতরাই প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর পৌছলাম সেই শান্তির জায়গায়৷ চলার পথের আঁকে বাঁকে পাহাড়ের ঢালে তৈরি থাকা বাড়ি গুলোর উপর রোদের স্নান করার দৃশ্য চোখে পড়ছিল। কিন্তু পিস প্যাগোডা তে পৌঁছে যে দৃশ্য দেখলাম তা অবর্ণনীয়। সকালে তখনো টুরিস্টরা তাদের গাড়ি নিয়ে ভিড় করেনি। পিস প্যাগোডা তে কাঠের যে ভাস্কর্য গুলো আচ্ছে বুদ্ধের জীবন নিয়ে সেই গুলো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। তারপর একসময় অগত্যা চলে এল ফিরে আসার পালা। শীতের আদরে মাখা দার্জিলিং ছেড়ে আসতে খুব খারাপ লাগছিল। শেয়ার ট্রেকারেই উঠলাম। দার্জিলিং আসার পথে রোহিণী চা বাগানের মাঝে রাস্তা দিয়ে কার্শিয়াং হয়ে এসেছি। যাওয়ার সময় ড্রাইভার মিরিকের রাস্তা দিয়ে শিলিগুড়ি নিয়ে এল। রাস্তাটি আরো রহস্যময়। ট্রেকারের ড্রাইভার বলেই ফেললো - এই দৃশ্য দেখতে মানুষ হাজার বার দার্জিলিং আসবে।
যে যাই বলুক, যত অফবিট লোকেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ুক, একা মানুষকে তার রাজকীয় স্বরূপ চেনাতে দার্জিলিং ই পারে। কোন ভিড় চোখে পড়বেনা। মনের অন্ধকার বিষাদময় কোণে যখন একটা আঁকা বাঁকা উঁচু নীচু রাস্তা, একধারে খাদে সবুজ গাছের সারি আর অন্যদিকে কাটা পাহাড়ের সবুজ দেওয়াল আর দূরে ডাক দিয়ে যাবে মেঘের আড়াল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন রাজকন্যের ঘুম ভাঙতে বাধ্য ।।
( এই ভ্রমণকাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে ইহার কোন মিল খুঁজিবেন না।)
No comments:
Post a Comment