পূজো চলছে - যেরকম প্রতিবছর চলে। নতুন কিছু নয়। সেই ক্লান্ত শরীরে ঘামে ভেজা জামা-প্যান্ট পরে আলোর রোশনাইতে মোড়া শহুরে রাস্তায় কাজ থেকে ফেরার গল্প - যেখানে বাদবাকিরা নতুন জামা-কাপড় পরে সেজে গুজে বেরিয়েছে ঠাকুর দেখবে বলে। প্রত্যেকটা জরুরী পরিষেবার সাথে যুক্ত মানুষ তার জীবনে এই বৈপরীত্য অনুভব করেছে। কখনো খুব কষ্ট হয়, কখনো কিছুই মনে হয়না। আমার জীবনে পূজো ওই ফাইনাল ইয়ার এম.বি.বি.এস অব্দিই ছিলো। ধীরে ধীরে তারপর আমার জীবন থেকে পূজোর আনন্দ হারিয়ে গেছে। পড়ে আছে - বুঝতে না পারা একটা যন্ত্রণা। পূজো আসে, মানুষের জীবনের সাথে যুক্ত মানুষ পালটায়। আজ যাকে শুভ সপ্তমী, অষ্টমী বলা হচ্ছে শুধুমাত্র পূজোর আনন্দ ভাগ করে নিতে - পরের পূজোতে সেই মানুষ পালটে যেতে পারে। এই পাল্টাতে পাল্টাতে একটা সময় পর আর আনন্দ থাকেনা। পড়ে থাকে কিছু স্মৃতির অধ:ক্ষেপ। এরপর থাকে আরো কিছু মানুষ। যাদের জীবনে পূজোর আনন্দ কখনো ফিরবেনা। যারা তাদের সন্তান হারিয়েছে। কাছের কাউকে হারিয়েছে। এরমাঝে যদি বিচার করি যারা সেজেগুজে ঠাকুর দেখতে বেরোয় তারা কেন বেরোয়?
কারণ তারা এইভাবে একে অপরের সাথে বেরিয়ে সামাজিকভাবে একাত্ম অনুভব করে। মানব সভ্যতার আদিযুগ থেকে এভাবে নানা অনুষ্ঠান মানুষকে মানুষ হিসেবে অনুভব করায়। শুধুমাত্র ট্রেন্ড অনুসরণ করতে মানুষ এটা করে তা বলাটা অতিসরলীকরণ হবে। এটা এক মানব প্রবৃত্তি - যার মধ্যে নেই সে হয় শয়তান, নয় ভগবান, নাহয় একটা ছারখার হয়ে যাওয়া জাহাজ।
এই তৃতীয় প্রবৃত্তির মানুষেরা খুব ইন্টারেস্টিং হয়, এরা চরম দু:খেও হাসতে জানে, চরম অন্ধকারে আলোকবর্তিকা নিয়ে হাঁটতে জানে - দরকারে একা হাঁটার ক্ষমতা রাখে। একা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পারে, একা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে পারে। একা নদীর ধারে গিয়ে বসে থেকে দেখে ধীরে ধীরে সূর্য কিভাবে অস্ত যায়। এদেরকে ভাঙা যায় - কিন্তু তারা আবার হাসিমুখে নিজেদের গড়ে নিতে পারে৷ এরা জানে কেউ কারো নয়। আর উপনিষদের সেই অমোঘ বাক্য এরা আত্মস্থ করেছে খুব ছোটবেলায় - where you are alone, there is no agony.. সমাজ এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। বাড়ির লোকজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা - এদের তাই আখ্যা দেওয়া হয় 'অসামাজিক'। এরা নিজেকে ভালোবাসতে জানে৷ তাই এদেরকে কেউ যখন ভালোবাসে তখন তাকে গভীর ভাবে ভালোবাসতে জানে এরা। কিন্তু সময় কঠিন জিনিস। কিছুই স্থায়ী নয়। ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে যায়। এদের 'জাহাজ-মাস্তুল- ছারখার' হয় - অন্ধকার আর অন্ধকার। তারপর আবার একদিন কাশফুলের বাগানে বসে বিকেলের শরতের আকাশে জমে থাকা পেঁজা তুলে দিয়ে এদের ঘা মেরামতি শুরু হয়৷ এরপর বসন্তের হাওয়াতে এদের মনের দোলনা নিজে থেকেই দুলতে থাকে৷ একদিন সে বুঝে যায় - সে একাই এতদিন আনন্দে ছিলো, একাই আনন্দে থাকবে৷ পূজো ঘুরে আসে - আর একদিন শারদপ্রাতে বাঁধা পড়ে কাজে। সব স্মৃতি মুছে যায়। কিছু স্মৃতি থেকে যায় অমলিন ভাবে। আমৃত্যু। এভাবেই চলতে থাকে এদের জীবন। তবু এদের হাসি কেউ কেড়ে নিতে পারেনা। উত্সবের আনন্দ মানুষ যখন ভাগ করে নিতে বাইরে বেরোয় - এরা সবার মাঝে নিজেকে খুঁজে পায় বাড়িতে বসে মুখে একগাল হাসি নিয়ে।
No comments:
Post a Comment