নয়নসম্মুখে তুমি নাই,/ নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই;/আজি তাই/শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।
তোমাকে দিয়েই ছোটবেলায় আমার চিঠি লেখার শুরু আর তোমাকে দিয়েই আজ শেষ।
আমার জীবনে অনেক মানুষের অনেক রকম অবদান রয়েছে। কিন্তু যে মানুষটি সাহিত্যে আমায় হাতে ধরে চলতে শিখিয়েছে, স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে, একটা সময় অবদি অনবরত উৎসাহ জুগিয়ে গেছে তিনি আমার মা র বাবা- তুমি, দাদু৷ ৩০ জানুয়ারি কাল রাতে তুমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে।
যেহেতু আমি ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট এ প্রায় সাড়ে চার বছর ডাক্তার হিসেবে কাজ করছি, মৃত্যু আমার মনে আর দাগ কাটেনা৷ শেষ দিকে তুমি একেবারেই শুনতে পেতেনা। আমায় চেঁচিয়ে বলতে হত কানের কাছে গিয়ে।
তোমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম," দাদু তোমার এত রোগ, কষ্ট হয়না? "
তুমি বলেছিলে - আমি সত্যিকে জেনেছি। আমি মুক্তির আলো দেখতে পেয়েছি। আমার আবার কিসের কষ্ট!?
তুমি আমায় শিখিয়েছ -
ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগৎ্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্।।
তুমি সবাইকে আলাদা ভাবে পড়াতে আর আমায় আলাদা ভাবে। আমার সাথে তুমি আলোচনা করতে। এই কবিতা টা নিয়ে তোর বিশ্লেষণ কি? আমি আমার মত বলতাম। তুমি সেটাকে সমালোচনা করতে যুক্তি দিয়ে। আমিও পালটা দিতাম।
আমি জানিনা আমি কিসব লিখছি। কারো মৃত্যুতে এতটা বিহ্বল নিজেকে লাগেনি। আমার যে উপন্যাস লেখার প্ল্যান ছিল সেখানে তোমাকে উত্সর্গ করার কথা ছিল। তোমাকে পড়ানোর কথা ছিল। সেটা আর সম্ভব হলনা৷
কিসব লিখছি।
অথচ আমি মা কে ২১ শে ডিসেম্বর,'২১ রাত 10.31 মিনিটে মেসেজ করেছিলাম -
"দাদু কেমন আছে? আমার দাদুকে খুব মনে পড়ে.. আর কাউকে না.. শুধু দাদুকেই.. He was my best teacher.. আমি চাই খুব তাড়াতাড়ি দাদু এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাক.. এই অবস্থায় দাদুকে দেখতে যেতে চাইনা.. ওনাকে তোমরা কেউ চেনোনি .. আমি চিনেছি.. এত জ্ঞানী একজন ব্যক্তি দাম পেলেন না.. আমি ওনার হয়ে দাম আদায় করে নেবো পৃথিবীর কাছে"
মেসেজের কারণ ছিল, আমি হঠাৎ ই মনশ্চক্ষে দেখতে পাই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ আর বলছ - আমি তো বাংলায় এম এ হয়েও দাম পেলাম না, তুই পারবি।
তার ঠিক একমাস পরে তুমি ঠিক চলে গেলে। এতগুলো ক্রনিক রোগ নিয়ে এত বছর কষ্ট পেয়ে আজ সব কষ্টের সমাপ্তি। আর "সমাপ্তি" নিয়ে কার সাথে আলোচনা করবো? রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এত পড়াশোনা আর কার আছে? অদ্বৈতবাদ, উপনিষদ নিয়ে কে আর আমার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করবে? আজ যে বড় একা হয়ে গেলাম। আমার নামটিও যে তোমার দেওয়া।
তোমার কাছেই আমার ব্রজবুলির পাঠ। "মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান" - তোমার গলায় এখন যেন কানের কাছে শুনতে পাচ্ছি। গীতা নিয়ে তোমার সাথে তোমার ঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা বিতর্ক হয়েছে। তোমাকে এই মরদেহে আর দেখে কি হবে? তুমি দাম পাওনি তোমার জ্ঞানের। কারণ আমার দেখা সব থেকে সহজ সরল ভালো মানুষ ছিলে তুমি। এই মরদেহ টা তোমার একটা ছেড়ে যাওয়া পোশাক মাত্র। যার আত্মায়, চেতনায় আমার দর্শনের হাতেখড়ি, তাকে নিয়ে শোক করবো না। তোমার কাছেই শেখা -
অশোচ্যানন্বশোচস্তুং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে ।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতঃ।।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি ।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য-
ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥
দাদু, তুমি ইহলোকের এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করে পরমাত্মা কৃষ্ণর সাথে মিলিত হতে চলে গেলে। তোমার সদাহাস্যজ্বল মুখের প্রত্যেকটা কথা আমার মনে থাকবে। দাদুর কাছে আমার আধ্যাত্মিকতার প্রথম পাঠ। দাদু আমায় হাতে ধরে দর্শন এর অন্ধকার পথে সেই ছোট থেকে চলতে শিখিয়েছে। দাদুর আর কোন সন্তান- সন্ততি - পৌত্র বা পৌত্রী দাদুর কাছে এত গুরুত্ব পায়নি, যতটা আমি পেয়েছি। ক্রিয়েটিভ হতে গেলে মনের মধ্যে যে ভয় থাকে, আমার মনের সেই ভয়ের প্রথম অপসারণ করেছে দাদু - সেই বাচ্চা বেলায় যখন আমার বয়স নয়-দশ হয়তো হবে। কান্না কাটি করা আমার সাজেনা দাদু, তাহলে সব শিক্ষা মিথ্যা। আমি খুব ভাগ্যবান আমি অনেক ছোটবেলা থেকে তোমার মত একজন প্রকৃত জ্ঞানী ও দার্শনিক মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। বদলে তোমাকে কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। তবে আমার মনের ভিতর তুমি সবসমসয় সদাহাস্যময় মুখ হিসেবে থাকবে, পথ দেখাবে। তুমি আমার বন্ধু, দার্শনিক ও পথ প্রদর্শক। তুমি মৃত্যুর চেয়ে বড়।
তুমি এখন কৃষ্ণর সাথে মিলিত। এই নশ্বর দেহের সমস্ত কষ্ট থেকে তুমি মুক্ত। কি লিখবো আর? ভালো থেকো।
"তোমারো অসীমে প্রাণমন লয়ে, যতদূরে আমি ধাই।
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই। "
ইতি
No comments:
Post a Comment