Friday, April 17, 2020

|| নীলরতনের পাঁচ রতন || ষষ্ঠ পর্ব || Be a Rebel ||

তৃতীয় সেমিস্টারের ক্লাসগুলো ছিল অসহ্য। বিশেষ করে মাইক্রোবায়োলজি ডেমো ক্লাসগুলো। ক্লাসে গেলে সব কিছু হিব্রু মনে হত। লোকজন প্রথম বেঞ্চে বসে নোট নিত। আমি আর ভগা শেষদিকে বসে বাইরের ছাতিম গাছটার দিকে তাকিয়ে ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে থাকতাম। কি পড়ছি, কেন পড়ছি কিছুই বুঝতে পারতাম না। তার উপর মাইক্রো ডিপার্টমেন্ট এ নতুন দুজন স্যার এসেছিলেন। একজন খুব ভালো, নরম স্বভাবের। অনেক জানেন। কিন্তু আমাদের দুজনের বুঝতে খুব সমস্যা হত। আমি পড়ার কোন কারণ খুঁজে পেতাম না। আর অন্য একজন কে আমার অসহ্যকর লাগতো। উনি প্র‍্যাক্টিকাল খাতায় আমাদের কালচার মিডিয়াম কালার পেন্সিলে এঁকে নিয়ে যেতে বলতেন।  একটু বেশি হলুদ হয়ে গেলো, একটু কম হলুদ হয়ে গেলো, আর একটু খয়েরি হতো এরকম নানারকম অযুহাত দিয়ে আমার আর ভগা দুজনের আঁকা কেটে দিতেন। মেয়েদের বা ফার্স্ট বেঞ্চের দিকে বসা ছেলেদের কিন্তু দিব্যি সই হয়ে যেত।

 ভগা একদিন ক্লাস থেকে ফিরে বললো - "উই হ্যাভ টু কিল হিম্। "

আমি ওকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম। আমি ঠান্ডা মাথার ছেলে। শান্ত, নরম স্বভাবের। স্কুলে স্যারেরা সবাই আমাকে "ভালো ছেলে" বলে ডাকতো। আমি একটা ভালো ছেলের স্টিরিওটাইপ হয়ে গেছিলাম। অনেক কিছুই অসহ্যকর লাগলেও চুপ করে থাকতাম তখন। কারণ, কোন সিস্টেম পছন্দ না হলে সেই সিস্টেম মেনে উপরে উঠে নিয়ম বদলাতে হয়। কিন্তু কতদিন, কতটা উপরে ওঠার পর বদল আনতে চাইবো? যাই হোক্, আমি শান্ত, কিন্তু ওর মাথা গরম। বলেছে মানে উল্টো পাল্টা কিছু একটা করেই ফেলবে।
ভগা বলেই চললো - "দেখ্ আমাকে বাড়ি থেকে মাসে আড়াই হাজার টাকা দেয়, তোকে দেয় দুহাজার৷ এতে সিগারেট ও ঠিকঠাক কিনতে পারিনা। বিড়ি খেতে হয়। আর মালটা পেন দিয়ে কেটে দেয়। আবার নতুন পেজ কিনতে লাগে। স্যারকে কত করে আজ বললাম, স্যার, আজ কাটবেন কাটুন, কিন্তু প্লিজ পেন্সিলে কাটুন। নাহলে আবার নতুন পেজের বান্ডিল কিনতে হবে। স্যার, পেন দিয়ে আরো বড় করে কেটে দিলো। "

আমি ওকে বললাম - "আচ্ছা, ঠিক আছে শান্ত হ। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু একটা সমাধান হয়ে যাবে। "

ওকে সান্ত্বনা দিলেও আমি জানতাম এভাবে কিছু ঠিক হবেনা। বাড়িতে শিখেছি শিক্ষকদের সম্মান করতে হয়। স্কুলে শিখেছি শিক্ষকদের অসম্মান করা পাপ। তাহলে কি করা উচিত?
আমি সেদিন সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। মাথায় একটা চাপ ধরে ছিল। যা ভাবার ভেবে ফেলেছিলাম। কয়েকটা কালচার মিডিয়াম এঁকে আমি একটা সিগারেটে টান মেরে পরদিন সকাল সকাল একা ডিপার্টমেন্ট এ গেলাম। আমার মাথায় তখন একটা কথাই ঘুরছিল। সিস্টেম চেঞ্জ করতে লাগবে। এমন সময়ে ডিপার্টমেন্টে গেলাম যখন কেউ সেরকম থাকেনা। ওই স্যার যথারীতি আবার পেন দিয়ে প্রত্যেকটা আঁকা কেটে দিলেন। আমার মাথায় আগুন চড়ে গেল। তবুও বরফশীতল ভাবে আমি স্যারকে বললাম, "স্যার আপনাকে একটা গোপন কথা বলার ছিল। "

স্যার বললেন - "বলো.. "

আমি বরফশীতল মাথায় বললাম - স্যার, আমরা হস্টেলের ছেলে। কাদের পেছনে লাগছেন একবার ভেবে লাগা উচিত।

স্যার উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে চেয়ার থেকে উঠলেন - এই তুমি কাকে কি..

স্যারের কথা শেষ করতে না দিয়েই আমি স্যারের কাঁধে হাত দিয়ে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। বললাম - "স্যার, ঠান্ডা হোন। জল খান। কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। আপনি তো আমাদের শিক্ষক। ছোট থেকে এটাই শিখেছি শিক্ষকদের ভগবানের মত শ্রদ্ধা করা উচিত। কিন্তু কাল রাতে যখন ডোমদের সাথে গাঁজা খাচ্ছিলাম, ঠিক করে এসেছি, সম্মান তাকেই করা উচিত যে সম্মানের যোগ্য। এই যে কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান ভুঁড়ি নিয়ে। মাথায় কখন একটা ইঁট পড়ে যাবে, কেউ জানতেও পারবে না কে ফেললো। সুতরাং আপনিও আপনার জায়গায় থাকুন, আমরাও আমাদের জায়গায় থাকবো। "
বলে স্যারের পায়ে একটা প্রণাম করে আমি বেরিয়ে এলাম। স্যারের জামা ঘামে পুরো ভিজে গেছিলো। আমি অনেক হাল্কা অনুভব করলাম।
হস্টেলে ফিরে ভগাকে বললাম - "যা চলে যা ডিপার্টমেন্টে, তোর সই হয়ে যাবে। "
ভগা বললো - আর তোর?
- আমি নকল সই করে নেবো, চাপ নেই।
- আরে ও তো মনে রেখে দিয়েছে আমাদের। ও জানে যে সই করেনি। মার্ক করে রেখেছে।
- তুই চাপ নিসনা। তুই যা। আমি আমারটা বুঝে নেবো।

সেদিন ভগা হাসিমুখে রুমে ফিরলো। ওর প্রত্যেকটা কালচার মিডিয়াম আঁকা নাকি খুব ভালো হয়েছে স্যার বলেছেন। সব একবারে সই হয়ে গেছে।
 "তুই ও যা। তোর ও হয়ে যাবে। " ভগা বললো।

আমি বললাম - না ঠিক আছে।

ওই যে বাঁধন একবার খুললো। তারপর আমি আর ঠিক পথে চলতেই পারলাম না। আমরা তখন সদ্য দাদা হয়েছি। হস্টেলে নতুন ফার্স্ট ইয়ার এসেছে। এ এক অদ্ভুত সময়। আমরা যে কাউকে ডমিনেট করতে পারি, এই প্রথম সেই স্বাদ পাওয়া। যাই হোক্, আমার ডমিনেশনের ইচ্ছে খুব একটা ছিলনা। কারণ আমাকে কেউ ডমিনেট করলে আমি নিতে পারিনা। যেটা নিজে নিতে পারিনা, সেটা অন্যের উপর করা ঠিক নয়। তবে বাকিরা বেশ মজা নিচ্ছিলো। দিনরাত বাচ্চাদের চাঁটাচাঁটি চলতো। আমাদের রুম থেকে অরুণদা বেরিয়ে গেছিলো। ফলে একটা বেড আমাদের ফাঁকা হয়েছিল। আমার রুমে তখনো নতুন কেউ আসেনি। আমার অনেক মাস পরে একবার বাড়ি যেতে হত।

আমি প্রবাল দাকে বাড়ি যাওয়ার আগে বলে গেলাম - "দেখো দাদা, যেকোন জায়গা থেকে ফার্স্ট ইয়ার আসে আসুক। কিন্তু বাঁকুড়া থেকে যেন না আসে। ওরা চরম গাঁতু হয়। নেওয়া যায়না। "

বাড়ি থেকে ফিরে যখন আমার রুম ৮৬ র দরজা টা খুললাম, আরেকটু হলে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যেতাম। যে রুমে সিনিয়রের সিগারেটের ধোঁয়া ভরে থাকতো, মদের গন্ধে ম ম করতো। সেই রুমে কেউ ধূপকাঠি জ্বেলে ঘন্টা নেড়ে পূজো করছে। সামনে আবার রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ছবি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম - এই ছেলে, তুই কে?
বললো - স্যার, আমি ফার্স্ট ইয়ার।
- ওহ্।
আমি ব্যাগ ট্যাগ রেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তোর বাড়ি কোথায়? নাম কি? "
- আমার নাম শ্রীমান বরেণ্য মিশ্র। বাড়ি বাঁকুড়া। আপনি ধর্মদাস দাদা তো?
আমি মাথা নাড়তে নাড়তে মনে মনে বললাম, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।

সে আমাকে বললো - স্যার, আপনি কি আর কিছু বলবেন?  আপনি অনুমতি দিলে আমি পড়তে বসবো। আমার পড়ার সময় হয়েছে।

- হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে। আর শোন্, আমাকে আপনি, স্যার এসব কে বলতে বলেছে?
- প্রবল দা।
- সে কে?
- আপনার অপর রুমমেট।
- ওর নাম প্রবাল দা।
- না আমাকে উনি বলেছেন ওনার নাম প্রবল দা। ওনাকে মোকাম্বো বলে ডাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এই দেখুন।

বলে আমাকে তার নোটবুকে দেখালো। সে হস্টেলের রুম অনুযায়ী সিনিয়রদের নাম একটা নোটবুকে লিখে সেগুলো রোজ সকাল বিকেল গাঁতায়। আমি বুঝলাম আমার মৃত্যু আসন্ন। এটাও বুঝলাম বরেণ্যকে রুমে প্রবল ভাবে বরণ করা হয়েছে। ও করুণ মুখ করে তাকিয়ে আমার দিকে, আমার অনুমতির অপেক্ষায়। আমি অনুমতি দিলে ও পড়তে বসবে। ওকে আর ঘাঁটাতে সাহস হলনা। ওকে অনুমতি দিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম। ঠিক করলাম এই প্রবাল দা কে ধরে কেলাবো আমি আজ। এলাম ৮৯ এ। প্রবাল দা ভগার কাছে আছে কিনা দেখতে। দেখলাম ঠিক তাই। ভগা, প্রবাল দা, বিশু, নীল সবাই মিলে বাচ্চা কাচ্চা সামলাচ্ছে।
প্রবাল দা আমাকে দেখে বেরিয়ে এলো হাসিমুখে ,দাঁত কেলিয়ে বললো
- কি, আলাপ হল?
- আমি বললাম, এ তুমি কাকে ঢুকিয়েছো? তোমাকে না বলেছিলাম বাঁকুড়া নয়।
- না ওকে তাড়িয়েই দিতাম। তারপর শুনলাম ওর কেউ একজন আমার বাবার পরিচিত। তাই তোর জন্য তুলে রেখেছি। তুই কিছু একটা কর্।

প্রবাল দা তো বলে দিল। কিন্তু আমি এই মহীরূহের সাথে করবো টা কি? স্যারকে যেরকম করেছিলাম সেরকম এর সাথে করলে যদি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, চাপ। অতএব আমি একটা কূটনৈতিক চাল চাললাম্।

রাতে গিয়ে বললাম,
 - বরেণ্য, তুই গান শুনিস?
বরেণ্য - হ্যাঁ। পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী শুনি।
- রূপম ইসলাম শুনিস?
- সে কে?

বেশ্। বেটা রূপম ইসলাম শোনেনি, মানে রক্ শোনেনি। ও ঠিক রাত এগারোটায় ঘুমিয়ে পড়তো। আমাদের তখন সন্ধ্যে। পরেরদিন আমি আমার পঞ্চ পান্ডব কে নিয়ে এসে রাত একটায় শুরু করলাম আমাদের রূপমীয় তান্ডব। বরেণ্য যোগনিদ্রা থেকে ধড়পড় করে উঠে পড়লো।
পরেরদিন প্রবালদা র কাছে প্রবালদার বাবার ফোন এলো। বরেণ্য আমাদের নামে ওর বাবাকে বলেছে। ওর বাবা প্রবালদার বাবাকে ফোনে বলছে।

প্রবাল দা ফোনে বললো - ঠিক আছে আমি ওকে সাবধান করে দেবো। আর হবেনা।

 প্রবালদা ফোন রেখে আমাকে বললো - ধীরু, এবার তো তাড়াতেই হবে। কিছু একটা কর।

এরই মাঝে বরেণ্য ওর ব্যাচে একটা সেনসেশন হয়ে গেছিলো৷ ৮৯ এ ভগার রুমে যে ফার্স্ট ইয়ার ঢুকেছে সে মাঝে মাঝেই ওর কাছে আসতো আর ভুলভাল প্রশ্ন করতো। 'বরেণ্য, তুই হাতের কাজ করিস তো? বরেণ্য তুই কি কি গাল দিতে পারিস?'
বরেণ্য জিভ কেটে বলতো - "ছি ছি ছি।"
এরকম করতো। ওদের অবসর সময়ের বিনোদন ছিল বরেণ্য।
অসুবিধে আরো ছিল। একদিন ক্লাস থেকে ফিরে দেখি, বরেণ্যর বাবা এসে তার মশারির খুঁটি টাঙিয়ে দিচ্ছে। আর একজন তার বেডের দিকের প্লাগ পয়েন্ট ঠিক করে দিচ্ছে।

আমাকে তারা দুজন দেখে বললো - নমস্কার।

আমিও প্রত্যুত্তরে নমস্কার বললাম।
 যাই হোক্, আমার মাথায় একটা বদ বুদ্ধি এলো। হোস্টেলের বেশ কিছু রুমে পর্ণোগ্রাফিক ম্যাগাজিন নেওয়া হত। তার মধ্যে রুম নং ৮৯ ও ছিল একটি। আমি গোটা হস্টেল জুড়ে সব পর্ণোগ্রাফিক ম্যাগাজিনের সব থেকে বাছাই করা ন্যুড ছবিগুলো ভালো করে কাঁচি দিয়ে কেটে আমার দিকের গোটা দেয়াল জুড়ে আঠা দিয়ে সেঁটে দিলাম। সেদিন সন্ধ্যেবেলা ক্লাসের পরে বরেণ্য ঢুকলো। আমার দিকের দেওয়ালে একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। আবার ধূপকাঠি নেড়ে পূজো করে পড়তে বসে গেলো। কিন্তু ও ভুলেও আর আমার দিকের দেওয়ালে চাইলো না। পরের দিন থেকে আমার রুমটা মিউজিয়াম হয়ে গেল। জুনিয়র, সিনিয়র, ব্যাচমেট রা সবাই আসতো গল্প করার নাম করে। এসে আমার দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে হা হুতাশ করতো। রুমে বরেণ্যর বাড়ির কেউ আসা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো।
একদিন প্রবালদার কাছে আবার ফোন এলো। এবার বরেণ্যর বাবা সরাসরি অভিযোগ করছেন - রুমে কিছু কুরুচিকর ছবি লাগানো হয়েছে, এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি?

প্রবাল দা বললো - দেখুন, কারো দেওয়ালে সে তার মতো ছবি লাগাতেই পারে।

প্রবালদার কাছেও ফোন আসা বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু নিয়তির এমন খেলা। যে বরেণ্যকে রুমমেট হিসেবে তখন বরণ করতে পারিনি, সেই এখন এই চল্লিশ বছর বয়সেও আমার বন্ধু। বরেণ্য এখন কথায় কথায় গাল দেয়। কুরুচিকর কথা বলে। সেই ধূপকাঠি জ্বালানো বরেণ্য নীলরতনে নীল তারা হয়ে গেলো। বরেণ্য এখন গান গায়। রক্ গান। কথায় কথায় -
"আই এম সো ফাক্ড আপ,ম্যান " বলে। বরেণ্য এখন একজন রেবেল।
নীলরতন জাদু জানে।

(To be continued)
( সব চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক)

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...