Wednesday, November 20, 2019

শূন্য

মানুষের অনেক রকম শখ হয়, কিন্তু কিছু মানুষ আছে যাদের শখ মাথায় চেপে বসে৷ যারা তথাকথিত নর্মাল তারা এদেরকে পাগল, ছিটগ্রস্ত, চং, সাইকো, ক্ষ্যাপা এইরকম বিশেষণ এ ভূষিত করে। আর খুবই দুঃখের সাথে বলছি আমি এই অ‍্যাবনর্মাল গ্রুপের মধ্যে পড়ি৷ যদিও আমার ব্যাপার টায় আমার ইনসাইট প্রেজেন্ট থাকে৷ সিপিএম এর মত খানিকটা। ভুল করি, আবার সেই ভুল স্বীকার ও করি। তো এরকমই একসময় গেছে দুবছর আগে যখন আমার রাস্তার ফকির বাউল হিসেবে জীবন কাটানোর খুব শখ হয়েছিল। শখ টা এমনই যে আমার মাথায় চেপে বসল। কিন্তু কোন পেশাকে চুজ করার আগে তার সুবিধে অসুবিধে জেনে নেওয়া দরকার ভালো করে। তাই ঠিক করলাম যারা এরকম গান গেয়ে ফকির বাউল হিসেবে ঘুরে বেড়ায় তাদের সাথে এক দুদিন কাটাবো, দেখবো আমার পক্ষে ওরকম জীবন কাটানো সম্ভব কিনা৷ মনে মনে ব্যাপারটা ঠিক করলাম কাউকে জানালাম না। এর আগে ছোটবেলায় একবার বাড়িতে জানিয়েছিলাম আমি হিমালয় যাবো, ওখানে গিয়ে গুহাতে থাকবো গায়ে ছাই মেখে । আমাকে নিয়ে দাদা-দিদিরা সবাই খুব খিল্লি করেছিল। তারপর থেকে আর নিজের এরকম শখ এর কথা কাউকে মুখ ফুটে বলা যায়না। এমনিতে রাত বিরেতে কোলকাতায় মাঝে মাঝে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি৷ কিন্তু ওটা কয়েক ঘন্টার ব্যাপার ছিল, এবার সারা জীবন ওরকম পেশার নেশায় আসার আগে একবার যাচাই করা দরকার৷ আমার এক পিসতুতো দাদা আছে। সে আধ-পাগল। মাথায় তার গুলো ঠিক ঠাক জায়গায় নেই। লোকে তারকাটা বলে। কিন্তু আমার মতে, মাথায় তার আছে, শুধু ঠিক ঠাক জায়গায় ঠিক ঠাক নেই৷ মানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যদি মোদীজি হন, আর পশ্চিমবঙ্গে যদি ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মুখ্যমন্ত্রী হন তাহলে পৃথিবী যেরকম চলবে ওর মাথাও সেরকম চলে। তার একজন বাউল ক্ষ্যাপার বাড়িতে যাতায়াত আছে। তাকে বললাম - "চল তোর বাউল ক্ষ্যাপার সাথে দুদিন কাটিয়ে আসি৷ "
তখন শীতকাল ছিল। সামনেই জয়দেবের মেলা। দুজন বেরিয়ে পড়লাম। কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে কৃষ্ণনগর হয়ে করিমপুর যাওয়ার বাসে উঠলাম। তখন সন্ধ্যে হয়েছে৷ বাসে দাঁড়ানোর জায়গা ছিলনা। আমি বাসের রড ধরে ঝুলে ছিলাম ত্রিভঙ্গমুরারি পজিশনে৷ ঘুমে ঢুলে পড়ছিলাম৷ একটা একটা বাম্পার এ বাসের রড মাথায় গাট্টা মেরে যাচ্ছিল। আমার দাদা বাম্পার গুনছিল। যখন নামলাম আমাদের গন্তব্যে তখন দাদা বললো - বুঝলি ৩৫ খানা বাম্পার।
আমি সায় দিলাম যেন আমিও গুনেছি। রাতের অন্ধকার নেমেছে।
একটা টোটো তে উঠলাম। কিন্তু টোটো তে দেখলাম প্যাকিং তখনো শেষ হয়নি। আমরা দুজন ছাড়াও আরো পাঁচ ছয়জন উঠলো টোটোতে৷ তারপর তাদের লোটাকম্বল দড়ি দিয়ে টোটোর ছাদে বাঁধা হল৷ ভয় হচ্ছিল বাউল ফকির হওয়ার আগে টোটো উল্টে টো-টো করে ঘোরার স্বপ্ন বিফল হবে। কিন্তু না , রাত ১০ টার দিকে নামলাম গাউস গ্রামে। শীতের কুয়াশা মোহময়ী হয়ে উঠেছিল। কুয়াশার ওড়নার আড়ালে চাঁদের আলোয় তার যেটুকু রূপ দেখেছিলাম এখনো চোখে ভাসে৷ পেট খিদেয় চোঁ চোঁ করছিল। ১০-১৫ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম ক্ষ্যাপার আখড়ায়। গোল হয়ে বসে দশ পনেরো জন আগুনে নিজেকে একটু গরম রাখছিল। তারা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ওঠার প্যান করছিল। আমাদের দেখে আবার বসলো। " চলো, আবার শুরু হোক "। শুরু হল রাউন্ড রাউন্ড অদ্ভুত ধূম্রপান। রাত এগারোটায় ক্ষ্যাপার বাড়িতে এলাম। কিছু হাল্কা মিষ্টি পিঠে জাতীয় খেতে দিয়েছিল। জিনিসটা কি বুঝিনি। কিন্তু শর্করা ভেবে আরামসে খেলাম। খেয়েই ঘুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠিক করে চোখও খুলিনি। দাদা ডেকে নিয়ে এল ছাদে৷ আবার শুরু হল রাউন্ড। ক্ষ্যাপা আমাকে ভালো করে আগাপাশতলা দেখলো৷ দেখে হঠাতই দাদাকে বললো এই তুই এর সাথে আমার কয়েকটা ছবি তোল৷ এই বলে আমাকে অদ্ভুত কিছু পোজ দাড় করিয়ে দিয়ে ছবি তুললো৷ আমি বুঝলাম ক্ষ্যাপা কে দিয়ে ফিজিক্স এর তারকাটার ইউনিট মাপা যেতে পারে। তার একটু পরেই ক্ষ্যাপা বললো - চলো তাহলে আমরা বেরিয়ে পড়ি অজয় নদের তীরের উদ্দেশ্যে। আমার দাদা ক্ষ্যাপা ভক্ত৷ সে একটা অ‍্যাম্বাসাডার ভাড়া করলো। ক্ষ্যাপা তার বড় একতারা টা আমাকে ধরিয়ে দিলো। গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছুটেছে দারুণ রাস্তা দিয়ে। দুপাশে সর্ষে ক্ষেত। ক্ষ্যাপা গান ধরলো। একতারা বাজিয়ে - ও দরদী গো, আবার যেন তোমার দেখা পাই৷
গান শেষ হতে না হতেই আবার এক রাউন্ড। গাড়ির ড্রাইভার রাউন্ডে অংশগ্রহণ করছে আর এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে৷ হঠাতই এক জায়গায় জোরে ব্রেক কষলো। কেন জানিনা৷ তবে বুঝলাম - হ্যাঁ মরতে পারতাম। কি আছে। চলো। একদিন তো সবাই মরে যাবো।
ক্ষ্যাপার উত্সাহে আমিও গান ধরলাম। ক্ষ্যাপা মজা পেয়ে গেল। আবার এক রাউন্ড। জানিনা এরকম কতক্ষণ চলেছি। শুধু বুঝতে পারছিলাম আমরা স্থির। আর রাস্তা পিছিয়ে চলেছে সময়ের মতো। একের পর এক গাড়ি কে আমরা ওভারটেক করে চলেছি৷ একটা গাড়িতে একজন মেয়ে কাঁদছিল। জানিনা কেন? প্রশ্নটা শুধু ওই কিছু সময়ের জন্যই ছিল মনে। তারপর ছিলনা। পেছনে ফেলে এসেছি যে।
সময় হারায় না, চারিদিকের দৃশ্য হারায়। বৃষ্টির রঙ পালটে যায়, রং পালটায় স্বপ্নের।
যে শৈশব সান্তাক্লজের ধারণায় বোকা হত, সে এখন সমাজ এর রীতিনীতিতে বোকা হয়। মাধ্যমিক এ ভালো রেজাল্ট করো, দারুণ জীবন হবে। তারপর উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট, গ্রাজুয়েশন, পোস্ট, পোস্ট পোস্ট চলতেই থাকে। কিন্তু সেই বোকা লোক দারুণ সুন্দর জীবন খুঁজে পায়না। বোকা বনে সে পেরিয়ে আসা সময়ের ছবি দেখে আর ভাবে হ্যাঁ আমি আগে তো খুব ভালো ছিলাম, অনেক বিশ্বাস ছিল। এখন শুধু অবিশ্বাস। আগে ভালো ছিলাম। আসলে গাড়ি চালানো খুব সোজা হত , যদি না রিয়র মিররে কোন গাড়ির ছবি তাড়া করতো। এক একটা গাড়ি ওভারটেক করলাম, গাড়ি ভ্যানিশ। না সেটা হয়না। কাউকে ওভারটেক করা যায়না জীবনে। সবাইকে রিয়র মিররে বয়ে বেড়াতে হয়।
বিকেলের দিকে পৌঁছলাম অজয় নদের তীরে। জয়দেবের মেলার আয়োজন বিশাল। আমি এর আগে বইমেলা গিয়েছি, খাদ্য মেলা তেও গিয়েছি। কিন্তু কোথাও ঢোকার মুখেই এরকম অস্বস্তি হয়নি। এখানকার বেশিরভাগ লোকজন বুড়ো, বুড়ি। সাধু, সন্ন্যাসী। বাউল। গেরুয়া পোশাকের ছড়াছড়ি। বিজেপির জনসভা বলে ভুলও হতে পারে। ক্ষ্যাপা তার পাগড়ি পড়ে বাউলের পোশাক পড়ে নিল। সকাল থেকে পেট খিদে খিদে বলে চেঁচিয়ে মরে গেল। রাস্তার দুপাশে জিলিপি, কাঠিগজা এইসব বিক্রি হচ্ছিল। আমি ভাবলাম ক্ষ্যাপা কে বলি ওইগুলো খাবো। কিন্তু ভয়ে চেপে গেলাম। এই জায়গায় ক্ষ্যাপা ক্ষেপে গেলে চাপ হয়ে যাবে। চারজন মিলে একটা সবজি বাজারে ঢুকলাম ক্ষ্যাপার নির্দেশে। আমি ভাবছিলাম সংগে তো রান্না করার কড়া ও নেই। সবজি বাজারে কেন ঢুকলাম৷ আমি ড্রাইভার দাদার সাথে এমনি কথা বলছি। এমন সময় ক্ষ্যাপা দেখি হাসিমুখে দাদা র সাথে চারটে বড় পলিথিন ভরে কি একটা কিনে এনেছে। চলো খাওয়া যাক। এই বলে চারজন ওই প্যাকেট ভর্তি মটরশুঁটি খেতে লাগলাম। এত খিদে পেয়েছিল, ছাড়িয়ে খেতেও বিরক্ত লাগছিল৷ খাওয়া যখন শেষ হল মনে হল কিছুই খাইনি। তবু মনকে সান্ত্বনা দিলাম - এতেই কাজ চালিয়ে নে আজ।
অজয় নদের তীরে গেরুয়া অরণ্যে আমরা মিশে গেছি। সন্ধ্যে নামছে দু তিন কিমি হেঁটে আমরা একটা একটু ফাঁকা দেখে পলিথিন পেতে বসলাম৷ অজয় নদের দিক থেকে চরম কনকনে ঠান্ডা বাতাস আসছে। আমি দুটো জামা, একটা শোয়েটার, তার উপর একটা জ্যাকেট পড়ে। তবুও ঠান্ডা লাগছে। মাথায় মাফলার টা আরেকটু টাইট করে বাঁধলাম। একটু পরে ওখান থেকে উঠে একজন বাউলের আখড়ায় ঘাঁটি গাড়লাম। এরকম জন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় ছিল, তাই সবসময় দাদাকে দেখে রাখছিলাম। রাতের মায়াবী আলো, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া, আর তার মাঝে ক্ষ্যাপা গান শুরু করলো - "মন বিবাগী বাগ মানেনা রে"। ক্ষ্যাপার গলায় বাস আর পাওয়ার অনেক বেশি৷ একতারা টাও বেশ বড়। একদিকে রাউন্ড চলছে, অন্যদিকে গানের সুর, কথার গাম্ভীর্য্য এ হারিয়ে গেলাম। জ্ঞান ছিল, হুঁশ ছিলনা।
যখন হুঁশ ফিরলো তখন বুঝলাম, আমার দাদা কোথায় হারিয়ে গেছে। চিন্তা ভাবলো আমার মনে আসবে। কিন্তু আমার চিন্তার রিসেপটর ব্লকড্ হয়ে আছে। তাই ভাবলাম - আসলে কে কার থেকে হারিয়েছি৷ ও না আমি। আমরা সবাই এই পৃথিবীতে লস্ট। কেউ কি জানি নিজেকে, নিজেকেই খুঁজে পাইনি, অন্যকে কি খুঁজবো।
আবার গানের সুরে হারালাম।একটু পরে আবার হুঁশ ফিরলো।
দেখলাম দাদা পাশে বসে উঁহুহু করে মাথা দোলাচ্ছে একতারা আর গুবগুবির তালে। আবার অনুভব করলাম পেটে খিদে পেয়েছে। ক্ষ্যাপা কে এবার বলেই ফেললাম৷ ক্ষ্যাপা খোশমেজাজে বললো - চল্ তাহলে। ক্ষ্যাপা একটা চপের দোকানে আমাদের নিয়ে এসে বললো - চপ।
আমি বললাম - ক্ষ্যাপা সারাদিন পেটে সেরকম কিছুই পড়েনি সেরকম। এখন চপ খেলে মারা যাবো। তুমি খেলে খাও, আমি খাবোনা।
ক্ষ্যাপা বললো - না, খেলে সবাই একসাথে একই জিনিস খাবো।
বলে হাঁটতে শুরু করলো। এরপর আর আমার মতামত দেওয়া উচিত নয় মনে হল। তাহলে পেটে হয়তো চপটাও পড়বেনা।
একটা চার দোকানো গিয়ে বললো - পাঁউরুটি৷
কয়েকটা অনেকদিনের বাসি পাঁউরুটি খেলাম সবাই মিলে।
রাতে শুলাম খোলা আকাশের নীচে৷ দু তিন রাউন্ড চলার পর। একটা মোবাইল যে আমার পকেটে আছে ভুলেই গেছিলাম শুতে গিয়ে খেয়াল হল৷ খুলে দেখলাম অসংখ্য মিসড্ কল আর মেসেজ। মেসেজ গুলো পড়ছিলাম এক এক করে। এমন সময় আবার ফোন এলো৷ চেনা নাম্বার। চেনা গলা। এক মহিলা কন্ঠ। কিন্তু অচেনা প্রশ্ন - আজ আপনাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে। দেখবেন না ??
আমি উত্তর দিলাম
- আমি এখন বাউল ফকির হয়ে গেছি, এসব রেজাল্ট আমার জীবনে খুবই তুচ্ছ ব্যাপার৷
ফোনের ওপাশ থেকে গালাগালির মত কিছু শুনলাম। ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে দিলাম।
তারপর সকাল বেলা ঘুম ভাংতেই দাদাকে বললাম - আমার এখানে নেট ধরছেনা। আমার রেজাল্ট দেখতে হবে। তাড়াতাড়ি ফিরি চল্ ৷ সেদিন বিকেলে কোলকাতা ফিরলাম৷ ওই তিনবেলা আমার জীবনের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়। জীবনে যখন খুব খারাপ মূহুর্তে আমি আসি, জটিল এই পৃথিবীতে ভয় লাগে বেঁচে থাকতে,
যখন ভেংগে পড়ি, চারিদিকে অন্ধকার দেখি, চারিদিকে কাজের অসহ্য চাপে নিজেকে বিপর্যস্ত মনে হয়, রাতে depression, স্ট্রেসে ঘুম আসেনা, প্রচুর কষ্ট হয়, তখন আমি ওই তিনবেলার কথা চোখ বুজে মনে করি। কান্না আসেনা, রাগ চলে যায়, ভুলে যাই খারাপ, অন্ধকার, আনন্দ - দুঃখ, যুক্তি, ভক্তি। একটা অনুভূতিশূন্য, চিন্তাশূন্য ভাব আসে৷ ঘুমিয়ে পড়ি শান্তিতে৷ বাউল হতে পারিনি। পারবোও না। ওই তিনবেলা কাটিয়ে বুঝেছিলাম। ওই লাইফস্টাইল আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওটা ক্ষ্যাপার পক্ষেই সম্ভব৷ কিন্তু বাউল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারি। স্বপ্নে কোন শারীরিক কষ্ট নেই। ঠান্ডা লাগার ভয় নেই। মৃত্যুর ভয় নেই। খিদে নেই। অপহরণ, খুন , হারানোর ভয় নেই। আছে শুধু শান্তি। একটা স্বচ্ছ সরোবর। যার জল একদম স্থির। পজিটিভ নেই, নেগেটিভ নেই, মন তখন একটা Null Set ।।

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...