Wednesday, November 20, 2019

রাম ও হিন্দু ধর্ম

অনেক কাল আগে এক জমিদার ছিলেন। জমিদার এর নাম ছিল দুর্লভ নারায়ণ। তিনি নামেই জমিদার ছিলেন, আসলে তিনি ছিলেন একটা বিরাট প্রদেশের রাজা, তার সাথে ম্যাজিক জানতেন। প্রদেশের প্রায় সকলেই তাঁকে ভয় ভক্তি করতেন৷ জমিদার এর একটি ম্যাজিক এর স্কুল ছিল। সেখানে তিনি ও তাঁর অনেক প্রাক্তন ছাত্রদেরকে নিয়ে ম্যাজিক শেখাতেন। তাদের মধ্যে একজন এর নাম ছিল ঐন্দ্রিল। ঐন্দ্রিল কে খুব ভালোবাসতেন জমিদার দুর্লভ নারায়ণ। তাই ঐন্দ্রিল কে নিজের ঘরের চৌকিদার বানিয়ে দিলেন তিনি। যাতে যে কেউ, যখন তখন ঘরে ঢুকতে না পারে৷ একদিন এক মহাপ্রতাপশালী বদমেজাজি ম্যাজিসিয়ান দেবজিত্, দুর্লভ নারায়ণ এর ঘরে এসে ঢুকতে চাইলো। বলা বাহুল্য যেহেতু আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিলনা তাই ঐন্দ্রিল ঢুকতে দিলনা।
দেবজিত্ রেগে তখন ঐন্দ্রিলকে বললো, "তোর এত বড় সাহস তুই আমার পথ আটকাস্। তোকে এখান থেকে বের করে দিতে হবে। "
দুর্লভ নারায়ণ হই হট্টগোল শুনে বেরিয়ে এলেন। বললেন - "হ্যাঁ, ঠিকই তো। শাস্তি তো পেতেই হবে। আপনার মত মহান মানুষের পথ আটকেছে!! "
কিন্তু যেহেতু দুর্লভ নারায়ণ এর ঐন্দ্রিল এর উপর দুর্বল জায়গা ছিল ৷ বললেন -
"ঐন্দ্রিল এর কাছে দুটো পথ আছে। কোনটা বাছবে সেটা ওর ব্যাপার৷ পথ দুটো হল ঐন্দ্রিল কে ম্যাজিক করে, ওকে আবার বাচ্চা করে পাঠানো হবে -
১) আমারই প্রদেশের এক খুব সাধারণ প্রজার বাড়িতে৷ তবে এরকম সাতবার জীবন চক্র শেষ হলে তবেই আবার আমার এখানে ফিরতে পারবে৷ অথবা
২) আমারই এক সমকক্ষ বন্ধু জমিদার প্রজাপতি র পরিবারে বংশধর হিসেবে। সেখানে ঐন্দ্রিল একজন পরম প্রতাপশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। পড়াশোনা করবে। এরকম তিনবার জীবন চক্র সম্পন্ন হলে তবেই আমার কাছে ফিরতে পারবে৷ তবে একটাই মুশকিল, সেটা হল- ওই তিনবার জীবনেই সে আমার শত্রু হবে। "
দুর্লভ নারায়ণ এর সেই ক্ষমতা ছিল ম্যাজিকে কিনা জানিনা। তবে প্যারালাল ইউনিভার্সে রামায়ণ এভাবে লেখা হতেই পারে৷ রামায়ণ মহাকাব্যে জয়-বিজয় ওরফে ঐন্দ্রিল, দুর্লভ নারায়ণ এর সেবা তে যাতে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে, তাই দ্বিতীয় পথ বেছে নেওয়ায় খানিকটা এভাবেই মহাকাব্য এর যে ঋণাত্মক চরিত্র রাবণ, তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
প্রসংগত বলি, আগের সব নাম আমার দেওয়া। যেমন দুর্লভ নারায়ণ হল বিষ্ণু। বিষ্ণুর অবতার সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগে যথাক্রমে নরসিংহ, রাম ও কৃষ্ণ রূপে এসে হিরণ্যকশিপু, রাবণ ও শিশুপাল দের একটা গট-আপ যুদ্ধে মেরে তাদের মুক্তি দিয়েছে৷ যাতে তারা মুক্ত হয়ে গিয়ে আবার বৈকুন্ঠে ফিরে চৌকিদারি করতে পারে! এত সাত কান্ড রামায়ণ লেখা হল তাহলে শুধু চৌকিদার তার কাজটা কোনরকম পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে ঠিক ঠাক করেছিল বলে। এসব পড়ার পর আর কোন চৌকিদার ঠিক করে তার কাজ করবে ??
রন্ধ্রে রন্ধ্রে বক্র ইংগিত না খুঁজে আসল প্রসংগ তে আসা যাক্। হিন্দু ধর্ম কে পৃথিবীর সব থেকে প্রাচীনতম ধর্ম হিসেবে মানা হয়, যা এখনও মানবসভ্যতায় টিকে রয়েছে। মহম্মদ, যীশু, বুদ্ধ এর জন্মের অনেক আগে কোন অজ্ঞাত সময়ে, কোন অজ্ঞাত ভাবে, কোন নির্দিষ্ট মুখ ছাড়া এই কনসেপ্টের জন্ম৷ এমন একটা জীবন দর্শন যাকে এত হাজার হাজার বছরে কেউ ধ্বংস করতে পারেনি৷ কারণ এই নয় যে, এই ধর্মকে কাউকে রক্ষা করতে হয়েছে, আমি ধর্মজ্ঞানী বা ধার্মিক নই, কিন্তু এটুকু বুঝি ধর্মের কাজ রক্ষা করা। ধারণ করা। ধর্মকে রক্ষা করার কথা বোধহয় কলিযুগে এক পায়ে দাঁড়ানো ধর্মের ষাঁড়ের পক্ষেই বলা সম্ভব৷ হিন্দু ধর্ম কখনো ধ্বংস হয়নি তার কারণ সময়ে সময়ে যখন বদ্ধ জলায় ধর্মের জল জমতে শুরু করেছে, কেউ না কেউ এসে সেই বদ্ধ জলাকে নালী কেটে অসীম সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছে৷ হিন্দু দের মধ্যেই এত রকম বৈচিত্র্য আছে গুণে শেষ করা যাবেনা। এই সব কিছু নিয়েই একসাথে হিন্দু ধর্ম৷ কোন একটা নির্দিষ্ট ধর্ম গ্রন্থ নেই হিন্দুদের, কোন নির্দিষ্ট কাউকে আর মানা হয়না যে বলে দেবে তুমি হিন্দু আর তুমি হিন্দু নও। যখন বেদ-বেদান্তের সংস্কৃত শ্লোক, সাধারণ মানুষ দের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে দেওয়ালে দাগ করতো, তাদের ন্যায় নীতির পাঠ সহজে শেখাতে রামায়ণ - মহাভারত লেখা বলে আমার ধারণা ৷ বিভিন্ন জায়গায় এই মহাকাব্য এর বিভিন্ন রকম বক্তব্য আছে৷ এটাই রামায়ণ, বাকিগুলো মিথ্যে কেউ বলতে পারবেনা৷ রামায়ণে র একটা ভার্সানে বলা হয় - রাম যখন রাবণ বধের জন্য যজ্ঞ আয়োজন করেছিলেন তখন শিব কে সন্তুষ্ট করার জন্য এক পুরোহিত এর প্রয়োজন ছিল৷ রাবণ ছিলেন শিবের বড় উপাসক৷ এরকমও শোনা যায় রাবণ শিব কে কৈলাস থেকে লংকা তে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করার পর শিব রাজী না হওয়ায় গোটা পাহাড় তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শিব তা হতে দেয়না। শিবের আঙুলের চাপে রাবণ একদিকে যন্ত্রণায় চিত্কার করে ওঠেন৷ আর একদিকে তিনি শিব এর উদ্দেশ্যে বন্দনা করে শিব তান্ডব স্তোত্রম্ গান যার মিউজিক দিতে তিনি তার শরীরের স্নায়ুগুলোকে মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট এর তার হিসেবে ব্যবহার করেন। শিব রাবণ কে "রাবণ" নাম দেন৷ তো যাই হোক, রামের যজ্ঞ করতে রাবণ কিন্তু এসেছিলেন৷ এসে তিনি নিজের বধের মন্ত্র নিজেই পড়ে গেছেন৷ এই রাবণ কে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না৷ বিষ্ণুর অবতার হলেন রাম ৷ তো এই ধণাত্মক চরিত্র রামায়ণে প্রজার কথায় নিজের স্ত্রী সীতাকে আগুনে হাঁটিয়েছেন, রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে দিয়েছেন, সব পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসার পর আবার তাঁকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলেছেন৷ আর অন্যদিকে ছয়বিদ্যা ও চার বেদে পন্ডিত রাবণ যখন যুদ্ধে এক এক করে হেরে যাচ্ছিলেন, তখন এক যজ্ঞের আয়োজন করেন - যে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করলে রাবণ জিতে যেতেন। কিন্তু বানরসেনা তাঁর স্ত্রীকে যখন আটক করে, তখন তিনি যজ্ঞ ছেড়ে উঠে আসেন স্ত্রীকে বাঁচাতে, তার রাজ্যপাট ধ্বংস হয়ে যাবে জেনেও। রাবণ কে বেশ কিছু জায়গায় এখনো দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়৷ হিন্দু ধর্ম এই কারণেই স্বতন্ত্র যে তার পুরাণে ধণাত্মক ও ঋণাত্নক দুই চরিত্রকে বিভিন্ন আংগিকে দেখানো হয়৷ দুই পক্ষকেই সম্মান করতে শেখানো হয়৷ যেখানে রাম ও পূজ্য, রাবণ ও। রাবণ মারা যাওয়ার সময় রাম তাঁর ভাই লক্ষ্মণ কে সেই মৃত্যুর মুখে থাকা রাবণের কাছ থেকে শাস্ত্র উপদেশ শিখে নিতে নির্দেশ দেন। রামায়ণ হল যেন আমাদের ভেতরের চেতনার মধ্যে চলা সংঘাত। যেখানে রাম ও আছে, রাবণ ও আছে৷ ভোটের ফল বেরোনোর পর যারা হঠাত্ করে হিন্দুত্ববাদের প্রচারে ঢাক ঢোল পিটিয়ে নেমে পড়েছেন, যাদের আগে কখনো কোন রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে দেখিনি, তারা যেন এই পুরো ব্যাপার টা ভুলে না যান যে ভারতের সংবিধানের কনসেপ্ট লুকিয়ে আছে হিন্দু দর্শনের বহু গভীরে। তাঁরা সেটা মনে রাখলেই দেশের ভালো। সর্বশেষে আমার নিজের একটি স্বীকারোক্তি - আমি ভগবান মানিনা, আমি বিশ্বাস করিনা ভগবান এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও পরিচালক। আমি মানি পদার্থবিদ্যা। বিজ্ঞানের নিয়মে এই মহাবিশ্ব তৈরি এবং চলছে৷ যতক্ষণ না ওইরকম সুদর্শন চক্র আর ধুতি টুতি পড়ে মাথায় সূর্য নিয়ে কেউ আমার সামনে আসছে আমি বিজ্ঞান মানি । ম্যাজিক ও দেখাতে হবে যেমন - ইচ্ছে আমার বহুদিনের, চাঁদ থেকে ঘুরে আসার । ভগবান পারেন কিনা জানিনা। তবে বিজ্ঞান পারে৷ তবে মানিনা বলে গল্প টল্প পড়তে, যেকোন দর্শন জানতে তো অসুবিধে নেই। তাই পড়েছি ৷ আমাকে আমার কথা বলাতে মারবেন না । কারোর ভাবাবেগে আমার কোন কথায় আঘাত লাগলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী । আপনার মতামত ভিন্ন হলেও তাকে সম্মান জানানোর ক্ষমতা আমাকে হিন্দু দর্শন শিখিয়েছে ।।

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...