Wednesday, November 20, 2019

মাঝরাতের ডায়েরিটা

 একজন ফরেস্ট অফিসারের কাছে ওর নাম্বার পেয়ে যাচ্ছি দেখা করতে। শালা আমরা এখানে টাকা-ফ্ল্যাট-গাড়ির দৌড়ে এখনো দৌড়ে বেড়াচ্ছি। মালটা নাকি কোন জংগলে লাস্ট সাত-আট বছর পড়ে আছে। অথচ আমাদের মধ্যে সব থেকে বেশি সোফিস্টিকেটেড লাইফস্টাইল ছিল ওর। ইন্টার্নসিপেই বলত এই চাকরের লাইফ ভালো লাগছেনা। দেখবি আমিও একদিন বস হব। আমার অনেক গাড়ি, ফ্ল্যাট থাকবে। সেইদিকেই যাচ্ছিল। সেলিব্রিটি লাইফস্টাইল থেকে হঠাৎ বিবাগী হয়ে গেল। হঠাৎ মানুষের কি যে হয় !! যে সবসময় প্রচারের আলোতে থাকত, সে আজ কেন অন্ধকারে চলে গেল এটা ওর কাছে গেলেই বোঝা যাবে।

২৫/১/২০২৮, সকাল ১০ টা

আমি এখন ওর ছোট্টো বাড়িতে উঠেছি। ছোট্টো বাড়ি, কিন্তু খুব যত্নে সাজানো, অবশ্যই বৌদি মানে ওর বউ এর হাতযশে। সামনে যেদিকে তাকানো যায় জংগল। সকাল দশটা, তবু কুয়াশার যেন ঘুম ভাংগেনি । বৌদিকে নিয়ে বলতেই হয় কয়েকটা কথা। একদম পারফেক্ট ম্যাচ,কোথা থেকে খুঁজে পেল কে জানে। আমি সকালে উঠে চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম- তোমার শাড়ি, গয়নার দরকার হলে কি কর ? এখানে আশেপাশে তো দোকান আছে বলে মনে হয়না।
বলল - আমার যা আছে বেশি আছে। এখানে গাছ পালারা এসবের কিছুই বোঝেনা। আর তোমার বন্ধু মনে হয় আমায় এভাবে দেখতেই বেশি পছন্দ করে। তাই দরকার হয়না।
যেমন বন্ধু, তেমনি তার বউ। মালটাকে বললাম, আমি এসেছি, আজকের রুগী না দেখলেই নয়। বলল - এখানে প্রাথমিক চিকিৎসক এরই বড় অভাব ভাই। একদিন না গেলে আমার হয়তো কোন ক্ষতি হবেনা। তবে এদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।
মালটা সেন্টু মাল ছিল জানতাম, হঠাৎ গাড়ি-বাড়ির চিন্তা ছেড়ে এরকম ফিলান্থ্রপিস্ট হয়ে গেল কবে থেকে কে জানে। তবে একটা কথা ঠিক, এখানকার পরিবেশ খুব মনোরম।

রাত ১২ টা

আজ যা হল, ভেবেছিলাম মনেই রেখে দেব। লিখে মনের ভাব প্রকাশ সম্ভব নয়। কিন্তু ডায়েরিতে না লেখা অবদি শান্তি হচ্ছিলনা। ঘুম আসছিল না। লিখে রাখি। আমার পরবর্তী প্রজন্ম এটা পড়ে যাতে আমার ভুল না করে। আজ বন্ধু খাওয়ার পর বলল চল তোকে আজকে স্বপ্ন-রাজ্যে নিয়ে যাব। আমি ভেবেছিলাম বাতেল দিচ্ছে। কিন্তু যা দেখলাম, লিখে বর্ণনা করার মত সাহিত্য আমার আসেনা। সহজ ভাষাতেই বলছি। ওর বাড়ির পিছন দিকে দশ মিনিট হেঁটে গেলে জায়গাটা পড়ে। একটা হ্রদ, পাড়টা বাঁধানো। হ্রদটা বেশ বড়। হ্রদটা ওপারে শেষ হতেই পাহাড় শুরু। রাত্রিটা ছিল পূর্ণিমা রাত্তির। আমরা চুপচাপ পাড়ে বসে রইলাম। চাঁদের আলোর ঘন কুয়াশায় বিচ্ছুরণ হচ্ছিল, আর সেই বিচ্ছুরিত আলো আমার নাগরিক চেতনাকে উদ্ভাসিত করে দিচ্ছিল। হতবাক হয়ে চেয়েছিলাম, পাহাড়ের খাঁজে চাঁদ এর দিকে। দূরে কোথাও থেকে হাতির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম।
আর হ্রদের অন্য দিকটাতে এক পাল হরিণ চাঁদের আলোয় জল খাচ্ছিল। কি করলাম সারা জীবন। এত টাকা দিয়ে শুধু কৃত্রিমের সাধনা করে গেলাম। নতুন গাড়ি কিনে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করলাম। বদলে কিছু ইগো স্যাটিসফাইং লাইক। হঠাৎ বন্ধু বাঁশি বাজানো শুরু করল। শীতের হাওয়া, হাতির ডাক, আর সেই বাঁশির শব্দ যেন একসাথে অনুরণিত হতে লাগল। বৌদি বন্ধুর গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম। যেন সামনে আমি এক অলৌকিক সুখ কে উপলব্ধ হতে দেখছি। ছোটবেলা থেকে সমাজ শিখিয়েছে যার বাড়ির গেটে ঢুকতে যতগুলো কুকুর তাড়া করে, যতগুলো দারোয়ান ঘাড়ধাক্কা দেয়, প্রয়োজনের তুলনায় যার গাড়ি বেশি, বাড়িতে থাকার জায়গা, ফ্রিজে রাখা খাবার বেশি, আলমারিতে রাখা পোশাক- পরিচ্ছদ বেশি তারাই আসল বড়লোক। আজ তো সব ধারণা কেমন যেন উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। না,না, কিচ্ছু চাইনা। শান্তি চাই।মনের দুর্ভেদ্য অরণ্যের গভীরতম গুহায় লুকানো সেই শান্তি চাই।আর কিচ্ছু নয়। এই পরীক্ষাটা পাশ করলে লোকে সাবাশি দেবে।এই গাড়িটা কিনলে লোকে হিংসে করবে। সারা জীবন যে ধন-খ্যাতির মোহ র পিছনে এভাবে ছুটেছি আজ সব বৃথা মনে হচ্ছে। মন লোকের কথায় শান্তি নয়, আজ নিজের শান্তি চাইছে। ধন্যবাদ বন্ধু। আমার জীবন বদলে দেওয়ার জন্য। ডাক্তারবাবু আজ দুধ-সাদা রঙের ফেরারি নয়, নীল-সাদা আকাশ চায় ।।

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...