সাল আনুমানিক ১৫০০। সন্তর্পণে সবার আড়ালে চোখের জল মুছলেন প্রৌঢ় ব্যক্তিটি। একটু আগেই তার বছর ৬ এর ছেলেকে আন্দীজ পর্বতমালার লুল্লাইল্লাকো আগ্নেয়গিরি র অনেক উপরে মাটি র ৫ ফুট গভীরে রেখে এসেছেন তিনি। লুল্লাইল্লাকো কথাটার আক্ষরিক অর্থ হল - মিথ্যে ছলনাময়ী জল। এরকম নাম হওয়ার কারণ - ওই আগ্নেয়গিরি হল পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। উচ্চতা অনেক হওয়ার কারণে উপরে বরফ থেকে গলে জল হয় , কিন্তু নীচে নামতে না নামতেই পাহাড়ের গায়ে শোষিত হয়ে যায়। তো যাই হোক, বর্তমান ম্যাপ অনুযায়ী, আর্জেন্টিনা আর চিলির বর্ডারে এই আগ্নেয়গিরি। যার খুব কাছেই আবার আটকামা মরূভূমি। আসলে আমরা আজ একটুক্ষণের জন্য চলে যাবো আমেরিকার ইনকা সভ্যতার সময়কালে। হ্যাঁ, ইনকা সভ্যতার বিস্তার বর্তমান পেরুর কুসকো কে কেন্দ্র করে হলেও তার বিস্তার আর্জেন্টিনা, চিলি অবদিও ছিল । প্রৌঢ় ব্যক্তিটির ছেলে কিছুতেই ওখানে যেতে চাইছিল না। প্রচুর ছটপট করায় ওকে নিজের হাতে শক্ত করে বেঁধে ওই আগ্নেয়গিরি র যেখানে উষ্ণতা জিরো ডিগ্রী সেলসিয়াস এর অনেক নিচে সেখানে মাটির পাঁচ ফুট গভীরে আরো দুজন মেয়ের সাথে ওকে নামিয়ে আসা হয়। ওরা খুব ভালো জানে, ওই ঠান্ডায় আর আটকামা মরূভূমির শুকনো ওয়েদার ওদের এখনো অনেক বছর একইরকম ভাবে রেখে দেবে। শুধু থাকবেনা ওদের প্রাণবায়ু। মমি হয়ে থেকে যাবে। বাকি দুজন ও ওদের মত একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির মেয়ে। একজনের বয়স বছর পনেরো। আর একজন ওর ছেলের থেকে একটু ছোট। ওদের সবাইকেই কোকো গাছের নির্যাস খাওয়ানো হয়েছে যাতে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে ওই বরফশীতল আবহাওয়া তে । শান্তিতে নিথর মোমের মূর্তির মত। ওদের প্রাণবায়ু বেরোলেই ইনকা সভ্যতার উপর যে দুর্ভিক্ষের অভিশাপ চলছে সেটা থেকে মুক্ত হবে এলাকা বাসীরা। এরকম বিশ্বাস তাদের। এই প্রথাকে "ক্যাপাকোচা" বলে। কে জানতো তার ১০০ বছরের মধ্যে ইনকা সভ্যতা কে গ্রাস করে নেবে কলম্বাসের পথ ধরে আসা স্প্যানিশরা। ওদের ভাষা বাংলা নয়। রবীন্দ্রনাথ তখনো জন্ম নেন নি। কিন্তু মানুষের অনুভূতি তো পালটায় না। কে জানত হয়তো ওই কাল্পনিক প্রৌঢ় পিতার মনে "দেবতার গ্রাস " কবিতার লাইনগুলোই এসেছিল। ওদের ওই বলিদান তখন কাজে এসেছিল কিনা আমরা নিশ্চিত নই। তবে কে জানত ৫০০ বছর পর ২০১৮ সালে সেটা কারো কাজে আসবে? কিভাবে?
তাহলে চলে আসুন , ২০১৮ বিশ্বকাপ পূর্ববর্তী ২০১৭ র কোয়ালিফায়ার ম্যাচগুলোতে চলে যাই। চলে আসা যাক টিম পেরুর অন্দরমহলে। নিজেদের টিমে গোল করার ভরসা একজন সে ব্রাজিলের ফ্ল্যামেংগো ক্লাবে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলে। পেরুর ক্যাপ্টেন পাওলো গুরেরো। ১৭ টা কোয়ালিফাইং ম্যাচ খেলে পেরুর বিশ্বকাপ খেলা তখনো নিশ্চিত হয়নি। এই অবস্থায় আর্জেন্টিনা র বিপক্ষে ম্যাচ খেলার পর ২০১৭ র ৩রা নভেম্বর পেরু টিমে খবর এল পেরুর ক্যাপ্টেন গুরেরো ডোপ কন্ট্রোল টেস্টে ফেল করেছেন। গুরেরো কে আপাতত ৩০ দিনের জন্য ব্যান করা হল। বায়ার্ন মিউনিখ ক্লাব এ একসময় খেলে আসা এই সিনিয়র প্লেয়ার কে ছাড়াই পেরু নিউজিল্যান্ড কে হারালো আর বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্র পেলো। কিন্তু বিশ্বকাপে যে ক্যাপ্টেনকে দরকার। এদিকে ৮ই ডিসেম্বর ২০১৭ তে প্রমাণিত হল গুরেরোর প্রস্রাবে পাওয়া গেছে কোকেন এর একটা মেটাবোলাইট - বেঞ্জোইলক্গ্নিন। তাই উনি এক বছর খেলতে পারবেন না। পেরু টিম ম্যানেজমেন্ট এর মাথায় হাত। খুব ভালো উকিল নিযুক্ত করা হল। কোনভাবে যদি প্রমাণ করা যেত যে পেরুতে যে কোকো পাতা থেকে তৈরি চা খাওয়া হয় সেখান থেকেও ওই বেঞ্জোইলক্গ্নিন তৈরি হয় তাহলেই এই নির্বাসন তোলা সম্ভব। গুরেরো র হয়ে তার উকিল সওয়াল করতে গিয়ে ফিরে যান ইনকা সভ্যতার ওই তিন মমির প্রসঙ্গ এ। ১৯৯৯ সালে আবিষ্কার হওয়া ওই মমি তিনজন এর শরীরে ওই মেটাবোলাইটটি পাওয়া যায়। এদিকে কোকেন কে কোকো পাতার অ্যাক্টিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট হিসেবে আইসোলেট করা হয় ১৮৬০ সাল নাগাদ। মমি গুলো তো তারও পুরানো। তার মানে ওদের শরীরে ওই মেটাবোলাইট এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, কোকো পাতার নির্যাস খেলেও ওই মেটাবোলাইট পাওয়া যেতে পারে। প্রত্নতাত্ত্বিক রা এই মতবাদের বিরোধিতা করতে পারেন না। কারণ তারাই ১৯৯৯ সালে ওই মমিকে গবেষণা করে বলেছিলেন, যেহেতু কোকেন তখনো আবিষ্কার হয়নি, কোকো পাতার নির্যাস খাইয়ে তাদের এইখানে ঠান্ডায় জমে যেতে ফেলে যায় ইনকা সভ্যতার লোকজন রা। এই সওয়াল শুনে ব্যান উঠে যায় গুরেরো র উপর থেকে। বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব পেরোতে না পারলেও অস্ট্রেলিয়া কে হারানোর পেছনে গুরেরো র অবদান বিশাল। একটা ভালো গোল নিজে করেছেন, একটা গোলের পেছনে গুরেরো র ক্রস। ফ্রান্স ও ডেনমার্ক কে গ্রুপ লিগে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে পেরু।
আমরা কেউ জানিনা, গুরেরো সত্যি কোকেন নিয়েছিলেন কিনা।
তবে এটুকু জানি, চিলি, প্যারাগুয়েকে হঠিয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলা পেরুর সম্মান রাখার পেছনে অবদান রয়ে গেলো সেদিনের ইনকা সভ্যতার তিন মমির।।
আমরা কেউ জানিনা, গুরেরো সত্যি কোকেন নিয়েছিলেন কিনা।
তবে এটুকু জানি, চিলি, প্যারাগুয়েকে হঠিয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলা পেরুর সম্মান রাখার পেছনে অবদান রয়ে গেলো সেদিনের ইনকা সভ্যতার তিন মমির।।
তথ্যসূত্র : Dr Angshuman Roy, Google news articles and Wikipedia
No comments:
Post a Comment