Sunday, July 29, 2018

ত্রিভুজ

কুয়াশা এত সকালে কাটার কথা নয়। বুড়ির দোকানের স্পেশ্যাল চা এক চুমুক মিষ্টি শব্দে গ্রহণ করলো ভূমিকা । প্রেসিডেন্সী থেকে ফিজিক্স অনার্স পাস করেছে সে । কথায় চোখে মুখে সবসময় বুদ্ধিমত্তার ছাপ। চা খেতে খেতে সিগ্রেট খাচ্ছিল ভূমিকা। পাশের লোকগুলো হাঁ করে দেখছিল । ভূমিকার তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে লিবারেল। তার হাতে সিগ্রেটটা যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি একটা অঘোষিত তাচ্ছিল্যের জিহাদ। তার পরণে একটা টিশার্ট আর জিন্স। চুল বয়েজ কাট্। পেপার পড়ছিল। আমায় পেপার থেকে মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করল, 'তা সুত্রধার বাবু আজ আপনি যাবেন কোথায় ?' আমি বললাম - 'আপনার সাথে সাথেই যাবো । নামবো একেবারে শেষে। যেখানে সবাই নেমে যাবে। '

- আচ্ছা আপনার আরেকটা নাম যেন কি ?

 - নেপথ্য।

- ও হ্যাঁ।

বলতে বলতে বাস চলে এল। আমরা দুজন উঠে পড়লাম। ফাঁকা বাস। ভূমিকার জন্য তবু সিট রেখেছিলেন তার সহযাত্রী বন্ধু - বান্ধবীরা। একসাথে গল্প করতে করতে যাবে বলে। আমিও গিয়ে ওইদিকেই বসলাম। বন্ধু-বান্ধবীর নামগুলো যেদিন প্রথম জেনেছিলাম খুব মজা লেগেছিল। কেন সেটা আর নাই বা বললাম। কিসব নাম। মাখন, প্রিয়া আর কোকিল। একদিন আমি বাসের শুরু থেকে উঠেছিলাম, যেখান থেকে মাখন আর প্রিয়া উঠেছিল। সেদিন বুঝেছিলাম মাখন প্রিয়াকে অন্য চোখে দেখে। কিন্তু প্রিয়া অলরেডি কমিটেড তাই মাখন প্রিয়ার জাস্ট গুড ফ্রেন্ড ঠিক যেমন সকালবেলার বাটার টোস্ট, উপরে একটু চিনি ছড়ানো। মাখন তার আর প্রিয়ার বাসযাত্রাটার একান্ত সময়টাকে যে কোকিল আর ভূমিকা এসে ঘেঁটে দেয় সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করেই ফেলে। যাই হোক, আজ এসেই ভূমিকা বকতে শুরু করলো।



****
প্রথম ভুজ - 'লি-বালের'



'আজ পুরো ঝেড়ে দিয়েছি ওকে।' মাথা নেড়ে জানালো ভূমি।

প্রিয়া জানালো - দেখ তুই আবার শুরু করবিনা ওর কথা।

মাখন বললো - আ: বলতে চাইছে বলতে দে না। কোকিল সম্মতি জানালো - কি বলেছিস বল তো। ভূমিকা বললো - আর বলিস না আমি কাল একটা ডিপি দিলাম আমার কতদিনের একটা বন্ধুর সাথে একসাথে। আমরা অলি পাবে মদ খেতে গিয়েছিলাম। ও দেখে সেই পজেসিভ কমেন্ট শুরু করলো। আমি কিছু বললাম না। বিকজ ইউ নো সবাই উত্তর ডিজার্ভ করেনা। ডিপি চেঞ্জ করে দিলাম, ও তখন কি বলল জানিস এটা সুস্থ পোশাকের পরিচয় নয়। ও যে আমার সাথে একটা রিলেশানে আছে ভাবতে কেমন লাগছে। আমি আর থাকতে না পেরে ওকে বলে দিলাম অসুস্থ ছোটলোক। নিজেকে সাইকিয়াট্রিতে দেখাতে। বলে ব্লক করে দিয়েছি। আর নিতে পারছি না জাস্ট। একটা বাল।

প্রিয়া বললো - ভালো করেছিস বাবু। সারাজীবনের ব্যাপার। আর তুই যেরকম। আসলে সব ছেলেরাই এক।

ভূমিকা এবার রেগে বললো- 'আমি যেরকম মানে কি, তোদের মত বউ সেজে থাকতে পারবো না। ইফ ইউ কান্ট চেঞ্জ দা বয়, চেঞ্জ দা বয়। আমার সিম্পল ফান্ডা। সারমেয়, শারুখেয় এরকম কত ছেলেরা আমার সাথে ডেটে যেতে চায়। ভাবছি এবার অন্য কাউকে সুযোগ দেওয়া ভালো। '

সবাই হা হা করে হেসে উঠলো। এমন সময় প্রিয়ার বয়ফ্রেন্ডের ফোন এল। 'হ্যাঁ বাবু, না বাবু। তুমি বিশ্বাস করো।' একটু আড়ালে এরকম চলছিল । সেই সময় ওই বাসটায় একজন ভদ্রমহিলা উঠলেন নর্থ-ইস্টার্ণ।

তাঁকে দেখে ভূমিকা 'চিংকি' বলে উঠলো। সবাই হা হা হি হি করে নিল। প্রিয়া ফোন রাখতে মাখন বললো - 'দেখছিস আমাদের মধ্যে একজন বলছিল ছেলেরা এই,ছেলেরা ওই সে কিন্তু সবার আড়ালে ঠিক সহ্য করে নিচ্ছে।' প্রিয়া কিছু বললো না। ভূমিকা বললো - হ্যাঁ করবেনাই বা কেন, ওদের তো বাড়িতে সব ঠিক।

কোকিল এবার মুখ খুললো - হ্যাঁ তো ? তোরও তো বাড়িতে ঠিক ছিল। তুই লিবারেল বলেই তো বেরিয়ে আসতে পেরেছিস।

মাখন বললো - তোরা এত লিবারেল লিবারেল করিস। লিবারেল মানে কি জানিস ? কোন ভিন্ন মতকে সম্মান জানানো। এই যে তোরা একজনকে চিংকি চিংকি করছিলি আমি কিন্তু সাপোর্ট করিনা। তবুও আমি কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে হেসেছি।


বলে একবার প্রিয়ার দিকে তাকালো সে শুনছে কিনা দেখে নিল। আবার বলতে শুরু করলো - আমি ভূমি যেগুলো করে সেগুলো মন থেকে সাপোর্ট করিনা। ও আবার তিনদিন পর কথা বলবে। এদিকে অন্যদের সাথেও ফ্লার্ট করবে।

ভূমি বললো - বেশ করেছি আমার ছাগল আমি কাটব না চরাবো আমার ব্যাপার।

 আমি এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলাম, এবার বললাম- বলছি ঝগড়া তো আপনাদের খুব জমে উঠেছে। আমি এতক্ষণ আপনাদের কথা শুনছিলাম। আপনাদের সাথে রোজ একসাথেই যাই। ভূমিকা আমায় চেনে। যখন আপনারা যেতেন না আমিই ওর সহযাত্রী ছিলাম। আমার মনে হয় ঝগড়া থামানোর একটা ভালো উপায় আছে। ভূমিকা বললো- কি?

আমি বললাম - আমার যা কাজ। একটা গল্প লিখেছি। গল্পটা আপনাদের মতই একজন ভদ্রমহিলাকে নিয়ে। রোজ বাসে আমাদের সাথেই যান। আমার সাথে আলাপ আছে নাম অন্তরা দেবী। গল্পটা লিখে ঠিক সুখ হচ্ছেনা। তাই আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি। আপনারা যদি কোন সুন্দর ফিনিশিং টাচ দিয়ে দেন বেশ হয়। আজকের যুগে আসলে গল্পে চমক না থাকলে মানুষের ইমোশনে ঠিক ঘা দেওয়া যায়না, তাই ভালো ফিডব্যাক পাইনা । আমার গল্পটা দার্শনিক হয়ে গেছে। রবিঠাকুরের যুগের অনুভূতির কচ কচানি এই যুগে কে পড়বে ? তাই মশলা চাই। মাংসের কষা টা যাতে আহামরি লাগে। যতবার পড়বে আলাদা মানে বেরোবে। মাখন বললে - 'বেশ, বেশ পড়ে শোনান। শুনতে শুনতে আমাদের গন্তব্য চলে আসবে। একঘেয়েমি কাটাতে আমাদের কিছু টুইস্ট সাজেস্ট করার থাকলে বলে দেবো। আপনার পাঠকরা পড়ে উদ্ধার করুক। '


আমি শুরু করলাম।



*****
দ্বিতীয় ভুজ-

'লাভের Love, Love-এর লাভ'


'সখী ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলি যাতনাময়, তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ভালোবাসা, ভালোবাসা '

হেডফোনে কানে পরিচিত গলায় গিটারের সাথে রেকর্ডিংটা শুনছিলেন অন্তরা দেবী। তাঁর ডাক নাম রেণুকা। ছোট করে সবাই রেণু বলে ডাকে। এমন একটা গলা যেটা শুনলে পাগলের মত ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। তাকে অনেকে অনেক ভাবে বুঝিয়েছে বেরোনোর উপায়, বা এটা ভালোবাসা নয় ইত্যাদি। এখান থেকে বেরোনোর উপায়, লোকজনের সাথে ভাঁটাও বন্ধু হিসেবে। কাউকে না কাউকে ভালো লেগে যাবে। সব বন্ধু, দাদা, দিদি কে বলেই দিয়েছে ওকে আর পাত্তা দেয়না। ওকেও বুঝিয়ে দিয়েছে, কিন্তু যে গানই শোনে মনে হয় ওর গলায় কি না ভালো লাগতো। ও তো ভেবেই নিয়েছে রেণু অন্য কারো সাথে রিলেশানে। ও ও হয়তো প্রেম করে নেবে । করুক। যা খুশি পাগলামি করুক। ওকে আর পাত্তা দেওয়া যাবেনা। অবহেলা করলে একদিন ও অন্য কারো সাথে চলে যাবে। রেণুও বসে থাকবেনা। অপশন খোলা রাখবে। আজ দেখলো ফেসবুকে একজনের স্ট্যাটাস 'অভ্যেসগুলো এখনো অবহেলার মানে ধরতে শেখেনি।' গানটা তাই হঠাত শুনতে শুনতে ভাবছিল, সত্যি ভালোবাসা মানে কি অভ্যেস ? রেণু কি সত্যিই ভালোবাসে ওকে ? ও বলে নানারকম দর্শন ভালোবাসার কিরকম ব্যাখ্যা দেয়। বাউলের নিষ্কাম প্রেমের সাধনা। রাধা-কৃষ্ণর প্রেমের ব্যাখ্যা। বিভিন্ন এদেশী, স্বদেশী কবিদের চোখে প্রেম। প্রকৃতি, প্রেমিকা, ঈশ্বর সব যেখানে মিলেমিশে একাকার। মাঝে মাঝে মন ভালো থাকলে শুনতে ভালো লাগে বেশ। কিন্তু এত ফিলোজফিতে তার মাথা গুলিয়ে যায়। ও কি সত্যি যা বলে অনুভব করে। অনুভব করলে মাঝে মাঝে এরকম ইনডিফারেন্ট হতে পারত ? অনেক পরীক্ষা করেও দেখেছে ও ওই ব্যবহারগুলো একা থাকার জন্যই করে, অন্য কোন মেয়েকে সময় দিতে নয়। রেণু কি করবে, ওর কথা ভাবলে ডুবে যায়, চেষ্টা করে তাই যতটা সম্ভব নিজেকে ডাইভার্টেড রাখার ওর থেকে। নানা ভাবে। ভুলে গেছে। আসলে প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে দুটো সত্তা থাকে। স্বপ্নবিলাসী আর বাস্তববাদী। ভালোবাসা এক, সম্পর্ক আর এক। সম্পর্কের মাধুর্য যখন কেটে যায় অভ্যসেটাই কোন সম্পর্ককে ধরে রাখে। তাতে ভালোবাসা থাকলো বা না থাকলো। আর ও বলে ভালোবাসা না থাকলে সম্পর্কের মরা অভ্যেসের কোন দাম নেই। ওর সাথে রেণুর আলাপ একটা মেন্টাল আসাইলামে। রেণু পেশায় একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। ওর সেলের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিল শুনছিল ওর গলায় -' তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা।' গান অনেকেই ভালো গায়। কিন্তু কিছু গলায় এমন ব্যথা থাকে ভেতরে স্বাদ লেগে থাকে। সেলের ভেতর অনুরণনটা ভেতরে অনুভব করছিল। বুকটা ধড়পড় করে উঠেছিল। কি অসাধারণ। তারপর ওর উপর একটা মায়া পড়ে যায়। এখন ওর আরোগেন্স অনেক কমে গেছে। ওর একটাই কথা -'মানুষ হল শিক্ষিত জানোয়ার। ' রেণু জানে ও মেন্টালি ডিসব্যালান্সড। কিন্তু এটাও জানে রেণু নিজে ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছে। এটাকেই হয়তো কাউন্টার-ট্রান্সফারেন্স বলে। আচ্ছা যদি ভালোবাসা অভ্যেসই হবে রেণুর ছয়জন বন্ধু সবাইকেই ওর ভালো লাগে আর অনেকদিনের বন্ধু। প্রায় নিয়মিত কন্টাক্ট। তাহলে এদের কাকে ভালোবাসে সে ? নাকি ওই পাগলটার প্রতি যে ভালোলাগার পাগলামি তৈরি হয়েছে সেটাই ভালোবাসা ? ওর খাতায় সেদিন রেণুকে নিয়ে কথায় কথায় ওর সামনে ও পেন নিয়ে লিখল । পড়ে দেখল - 'আমার মুক্ত সরলরেখা কবে এক জোড়ায় বৃত্তের সমীকরণ হল তোমার ছায়া ধরে। সেই পেয়ার অফ স্ট্রেট লাইন কখনো সসীম বৃত্ত, কখনো অসীমে বিলীন। আর একটু সময় ভালোবেসো, হয়তো যে স্বপ্নেরা গোলাপ ফোটায়, সে স্বপ্নেরা তোমার আমার ঠোঁটে বাসা বাঁধবে।'


শুধু অভ্যেসে এত অবলীলায় এই লেখা সম্ভব ? ও বলে - 'ভালোবাসা একটা কোয়ান্টাম পসিবিলিটি ওয়েভের মতো। একটা একটা ফেজে আসে। একটা একটা পকেটে। যেরকম সমুদ্রের তীরে একটার পর একটা ঢেউ আছড়ে পরে। ফেজে। একটা ঢেউ জানেনা পরের ঢেউএর টাইম টেবিল। কিন্তু বালুতট জানে সমুদ্রের পরের চুম্বনটা তার জন্যই রাখা। সমুদ্রও জানে বালুতট এর মনের কথা। এক্ষেত্রে অবশ্যই কথা টা হচ্ছে বঙ্গোপসাগর যদি আরব সাগরের তীরের মনের কথা জানে ভেবে ভাবে যে তাকে ভালোবাসে তবে হাস্যকর। যেমন একটা জাহাজের জন্য প্লাটফর্মে ওয়েট করা যায়না। এসব মহান অনুভূতি তাই যোগ্য পাত্রে দান করা উচিত। তুমি সেই আধার।'


ওকে মাঝে মাঝে বলে তোমার এসব লেখা আমি যদি লিক করে দিই নিজের নামে, বা অন্য কেউ মেয়ে পটানোর কাজে ব্যবহার করে ? তোমার চিন্তা হয়না? ও বলে-' হ্যাঁ , আমি অনেকের প্রেমপত্র লিখে দিয়েছি। কিন্তু চিন্তা হয়না। লেখাগুলো তো আমার নয়।'

রেণু মুখ বেঁকিয়ে বলে - ও আপনিও তাহলে অন্যের টুকে মেয়েদের মনে প্রভাব বিস্তার করেন।

ও বলে - কি জানি টুকে কিনা, তবে আমাকে নিয়ে কেউ যেন লেখায়। আর আমি তখন এই জগতে থাকিনা।


রেণু অবাক হয়ে তার কথা শোনে। সত্যি না অনুভব করলে এভাবে ভাবা যায়, বলা যায় ? ভুলে যায় এটা ২০১৬ সাল। নাকি সৃষ্টির শুরুতে সে আদমের সামনে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর একমাত্র নারী হিসেবে একমাত্র পুরুষের কথা শুনছে। এই যুগে কে এত গভীরতা নিয়ে ভাবে ? মাঝে মাঝে তার এত স্বপ্ন, দর্শন পোষায়না। পাতি বাস্তব ধরে ভাবলে সে কোন কুল কিনারা পায়না। ওর সামনে এসে সময় থেমে যায়। সব দুশ্চিন্তা ভুলে যায়। মনে হয়, অনেক কিছু মনে হয়। মাঝে মাঝে সত্যি কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। হ্যাঁ কিছুদিন প্রেম করার জন্য ঠিক আছে, কিন্তু সারা জীবন। না না। একটা পাগলের সাথে সারা জীবন কাটানো যায় না। সে তো অনেকের গলাই ভালো লাগে, তার মানে কি তাদের সাথে প্রেম করবে ? তার নতুন কয়েকটা বন্ধু হয়েছে। ও নতুন প্রেমে পড়লেই রেণু তাদের একজনকে ধরে বিয়ে করে নেবে। কাকে যে আসলে ভালোবাসে, সেটাই বুঝতে পারেনা রেণু। ওর মত স্বপ্নের দুনিয়াতে ভেসে গেলে মনে হয় ওকেই। কিন্তু বাস্তবে এলে এমসিকিউ চলতেই থাকে শেষ হয়না। শান্তি পাবে কি করে ? সোজা কথায় এত না ভেবে বেঁচে থাকতে গেলে কারো কন্সট্যান্ট কেয়ারে থাকতে হবে। তাই এত স্বপ্ন না ভেবে বাস্তব ভাবলে কারো সাথে রোজ শান্তিতে বেঁচে থাকাটাই ভালোবাসা। Love নয় লাভ চাই সবার। রেণুর বান্ধবী খুব পরিণত বাস্তববাদী।বলে-' বয়স হয়েছে এবার সেটলমেন্টে আসতে হবে। না ভেবেচিন্তে কাউকে আই লাভ ইউ বল। ডেট কর। কিস্ কর। দেখ এসব করার পর সে তোর আঁচলে বাঁধা থাকছে কিনা। না থাকলে ওকে স্ট্যান্ডবাই রেখে নতুন খোঁজ। একইভাবে। যেখানে লাভের গুড় মিলবে সব থেকে বেশি সেখানে বাসা বাঁধো। বাকি সবাইকে বন্ধু বানিয়ে নাও। '

রেণু বলে, 'ভালো না বেসে কিস্ করবো ? '

তার বান্ধবী বলে -' হ্যাঁ করবি। ছেলেরা এই যে বাতেলা করে প্রেমের, কেন করে মেয়েদের কাছে এসব পাওয়ার জন্যই তো। মেয়েরা কাছে কেন যায়, ছেলেদের পারমানেন্ট খুঁটি বানিয়ে রাখার জন্য। এটাই মোদ্দা কথা। যে খুঁটির শিকড় যত গভীরে সেই খুঁটি বেশি লাভবান। কাছে গেলেই ছেলেরা খুশি। আর যদি ছেড়ে দিতে হয় এভাবেই দেখাবি দোষটা ওরই ছিল। সোজা কথা যে শান্তিতে রোজ ঘুমাতে দেবে তার রোজ খোঁজ নেওয়াটাই ভালোবাসা।'


এভাবে লাভ দেখে Love হয় ? কিছুটা নরমাল জীবনে ফেরার পর ওকে অনেক ভাবে আবার খোলাখুলি প্রোপোজ করাতে চেষ্টা করে রেণু। কিন্তু পারেনা আর। এর থেকে ওরাই কেউ ভালো ছিল। সত্যি কথা বলতে মনে অশান্তি হলেও ও এমন কথা বলে শান্তি আসে। ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল - কাকে ভালোবাসেন আপনি ?

বলেছিল - 'পরে বলবো। '

তারপর দু'রাত পরে এসে বলেছিল, 'দু'রাত না ঘুমিয়ে ভেবে দেখলাম আমি কোন মানবীকে ভালোবাসার যোগ্য নয়।' রেণু জিজ্ঞেস করেছিল - 'তবে ?' ও রেণুর হাত ধরে হিড় হিড় করে ছাদে নিয়ে গিয়ে খোলা মাঠ দেখিয়ে বলেছিল - 'ওই যে বিরাট পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে, ওই যে দূরের ঝিলে ঝুপ করে সন্ধ্যে নামছে, ওই যে সূর্যটা মা'র টিপের মত দিগন্তে মিশে যাচ্ছে ওদের সবাইকে ভালোবাসি।' তারপর একটা গাছকে দেখিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল - 'ভালোবাসি।' এ কি সত্যি এরকম। অনেকটা নরমাল হওয়ার পর ওকে সিডিউস করার বহু চেষ্টা করেও পারেনি। ও পাগল। এটা বুঝেছে। আগে প্রচন্ড আরোগ্যান্ট ছিল। এখন আর নেই। রেণু একদিন জিজ্ঞেস করেছিল - 'আমি অন্যকাউকে বিয়ে করে নেব ভাবছি।' ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর আবার রেণু বলল -' আপনি কি করবেন আমি বিয়ে করে নিলে ?' ও কোন উত্তর দিলনা। পাশ দিয়ে একটা বাচ্চা মার কোলে হাসছিল তাকে দেখিয়ে বললো হঠাত - 'দেখো দেখো। ' বলে নিজে খিল খিল করে হাসতে লাগলো। এতক্ষণ সূর্যের আলোটা একটা বট গাছের মগডালের ওপারে ঢাকা পড়ছিল। হঠাত সেই সূর্যের আলো ওই বটগাছের শেষ পাতাকে চুম্বন করে ওর মুখে এসে পড়ল। মুখ তুলে তাকিয়ে বললো- 'ছবি আঁকবো আপনার। নতুন গান লিখবো। কবিতা লিখবো। '

 'কি লাভ এসব করে ? কি পান ? ' চেঁচিয়ে জানতে চেয়েছিল রেণু।

 'মাঝে মাঝে পাই,সব সময় পাইনা। পেলে ভালো হত। ' বলে রবি ঠাকুরের মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাইনা গাইতে গাইতে চলে গেল। দূরে গিয়ে আপন মনে মাউথর্গান বাজাতে লাগল। ' এটা তো ব্রম্ভসংগীত !! এইসব আঁতলামি সময়ের সাথে সাথে হাস্যকর মনে হচ্ছে তার। টিনেজ চিন্তাভাবনা। কথাটা বলতে ও একদিন হেসে বলেছিল- 'হ্যাঁ এটা ঠিক। ভাবুন রবি ঠাকুর শেষ বয়সেও টিনেজ কবিতা লিখে গেছেন। ' ওর সাথে কথায় পারা যায়না। কখন আপনি বলে, কখনো তুমি। মাঝে মাঝে দুকানে দুহাত চাপা দিয়ে ও বলে- ' আমি আর ভাবতে পারছি না। পাগল হয়ে যাব।' পুরো পাগল। নেহাত পাগল তাই কিছু বলতে পারেনা। সে বছরের বসন্ত মাস। গাছের পাতারা বাতাস আর অভিকর্ষের মধ্যে মারামারি চালাচ্ছে। রেণুর চোখে স্বপ্নের মোহ কেটে গেছে। রেণুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। লাভ ম্যারেজ।





******
তৃতীয় ভুজ- 'ক্রসিং ওভার'



নিজের লেখা এতটা গল্প পড়ে একটা বড় শ্বাস নিলাম। সবাই চুপ করে ছিল। প্রিয়া হঠাত বলে উঠলো - এখানেই শেষ ? আর নেই ?

আমি বললাম - না। এরপর কি লেখা যায় বুঝতে পারছিনা।

মাখন বললো - সেই একই বিষয়, বড় একঘেয়ে। এত শোকের ছায়া গল্পে। সারকাজম হলে ভালো হত মাঝে মাঝে। ভূমিকা এতক্ষণ থমথমে মুখ নিয়ে বসেছিল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন একটা অন্য পৃথিবীতে ছিল।

হঠাত ভূমিকা বলে উঠলো - আপনার যেটা আসবে সেটাই তো লিখবেন। বিনোদন অনেকে করে। অভিনয় করেন সৌমিত্র। আপনি কোনটা হবেন আপনার ব্যাপার। আর তাছাড়া শোক ছাড়া তো শ্লোক হয়না। আমি উতসাহ পেলাম শুনে।

কোকিল বললো - ভূমি এসব কথা কার মুখে শুনছি ?

ভূমিকা বললো - কেন আমাকে কি ভাবিস?

মাখন বললো - তুই বাতেল না দিয়ে বরং শেষটা কিরকম হবে সাজেস্ট কর।

 আমি তাড়া দিলাম - হ্যাঁ ম্যাডাম বলুন বলুন। ভূমিকা শুরু করলে - অন্তরা দিয়ে জিনিসটা বেশ হল। সমাপ্তিটা আমিও দিতে পারবো না। ওটা আপনার কাজ। তবে একটা লেভেল ক্রসিং এর গল্প বলতে পারি। ওকে নিয়ে কিছু ফাঁক ফোকর বুজে দিতে পারি। ও পাগল। ওর মাথায় সব সময় কিছু না কিছু ঘুরছে। প্রচন্ড রকম মুডি। ও মানুষ খুব ভালোবাসতো। ওর পেশাটা ডাক্তারিই ধরা যাক। ওর পাশে শুলে একটাই প্রবলেম। ও যদি ডিউটি থেকে বাড়ি ফেরে মাঝরাতে কিরকম হয় জানেন তো। ধরুন আপনি ঘুমাচ্ছেন। হঠাত মাঝরাতে শুনলেন ও ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। বিড় বিড় করছে - 'হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে চলে আসুন। না না কোন চিন্তা নেই। চাদরে মুড়ে নিয়ে চলে আসুন। ' আপনি ভাববেন কে এত রাতে ফোন করেছে রুগী দেখাতে। দেখবেন ও আসলে আপন মনে বকছে। একবার ও একটা গানের কাজ করছিল। ওর মাথাতেও ওটাই ঘুরছিল।গানের লিরিক্স, সুর। এতটাই যে শিয়ালদহ তে টিকিট কাটতে ভুলে গেল। ও টিকিট কাটবে না এটা হতে পারেনা। কিন্তু ওর খেয়ালই নেই। বিনা টিকিটে প্লাটফর্মে ঢুকছিল এমন সময় এক টিটি র সাথে ধাক্কা লাগলো। টিটি কে দেখে ওর টিকিট কাটার কথা মনে পড়ল। এতটাই অন্যমনস্ক ছিল টিটি র মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো -' এই রে আমার তো টিকিট কাটা হয়নি। যাই টিকিট কেটে আসি।' টিটি ওকে খপ করে ধরলো। ও এতটা বোকা নয়। কিন্তু যখন যে চিন্তায় ডুবে থাকে এরকমভাবে। ওকে তখন ঘাঁটালে ক্ষেপে যায়। ওটাই অন্তরা আর ওর শেষ দেখা ছিল। অন্তরার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল ও। একটা প্লাটফর্মে অন্তরা আসত দেখা করতে। অন্তরার মুখে শুনল ওর বিয়ের কথা। তারপর প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে অন্তরা একদিকে চলে গেল। ও রেলগেটের অন্য দিকে। রেলগেট পড়ে গেল। ও বিদায়সূচক হাত নাড়ল। তারপর মাঝখানে ট্রেন পেরোচ্ছিল। অন্তরা উঁকি ঝুঁকি মারছিল ওকে দেখার জন্য। খুঁজে পাচ্ছিল না। কখন ট্রেনটা শেষ হবে। ট্রেনটা শেষ হল। লেভেল ক্রসিং এর এপারে দাঁড়িয়ে অন্তরা আর ওকে খুঁজে পেলনা।

এতটা বলে ভূমিকা থেমে গেলেন। সবাই চুপ। শুধু উল্লাসটা আমার মধ্যে ছিল।

প্রায় লাফিয়ে উঠলাম- পেয়েছি। দারুণ। আমায় এখুনি লিখতে হবে। আমি নামি।

মাখন বললো -' আরে চললেন কোথায় ? মাঝরাস্তায় ? '

আমি বললাম - আমার কাজ শেষ। সামনে আমার এক বন্ধুর অফিস। ওখানেই গল্পটা লিখে ফেলতে হবে। নাহলে ভুলে যাবো। চলি আবার দেখা হবে। ভূমিকা বললে - 'সূত্রধার বাবু, শুনুন একটা অনুরোধ। গল্পে মেয়েটির নাম অন্তরা না দিয়ে সমাপ্তি দেবেন। আর জানবেন ছেলেরা যেরকম গল্প, সাহিত্য, সিনেমার নায়কদের সাথে নিজেদের মিলিয়ে স্বপ্নে ভাসে কেউ সামনে, কেউ মনে। মেয়েরা কিন্তু নিজেদের স্বপ্নে ভাসে। একান্তই নিজেদের। সেই স্বপ্নগুলোই ওদের সব হয়। তাই এসব গল্প পড়ে দেখলে মেয়েদের বড্ড বেশি বাস্তববাদী চরিত্রহীনা লাগে। অন্তরা কিন্তু সেদিনেই সমাপ্তি হয়েছিল। ' বলে ভূমিকা ছল ছল চোখে বাইরে জানালা দিয়ে তাকালো। আমি নেমে পড়লাম। বাসটা চলে গেল আমাকে নামিয়ে। সামনের ফ্ল্যাটের রেলিং এ হাত দিয়ে থেকে দাঁড়িয়ে বাসটাকে দেখছিলেন সমাপ্তিদেবী। তাঁর মাথায় সিঁদুর। বাসটা যেন এতক্ষণ তার মনের তিনটে স্তরের রাস্তায় চলছিল ।।

No comments:

Post a Comment

পাঁচ মিনিট

"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে ...