"বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! " কথাটা শেষ করতে না করতেই গলা ধরে এলো কিরণ এর। হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট এর বাইরে চেয়ারে বসে ওই অবস্থায় তার বন্ধু সুমন কে আঁকড়ে কেঁদে ফেললো কিরণ। নিজেকে আটকাতে পারলোনা। পারবেই বা কি করে! ফিজিক্স এর পিএইচডি স্কলার তিন বন্ধু কিরণ, সুমন আর পলাশ। সেই স্কুল জীবন থেকে বন্ধু তারা। একই কলেজ। একই ইনস্টিটিউট এ পিএইচডি। কজনের এরকম ভাগ্য হয়। ফিজিক্সের বাইরে তারা কিছুই বোঝেনা। সিসিইউ র বাইরে যখন ডাক্তার এসে বললেন যে
"তোমার বন্ধুর হার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আমরা চেষ্টা করছি ফেরানোর, কিন্তু আর ৫ মিনিটে না ফিরলে আশা নেই, ৫ মিনিট পরে বলছি। "
তখন দুজনেই ভেঙে পড়ল। হ্যাঁ, দুজনেই জানে পলাশ কেন বিষ খেয়েছে। মেয়েটার নাম তনুশ্রী । সেই কলেজের প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই পলাশ কয়েকদিন এই পুরো অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। সব সময় আলাদা ঘুরে বেড়াতো একা একা, চুপচাপ। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতনা। কিন্তু এরকম যে হঠাত করে বসবে কে জানতো!!?? বেশ কিছুদিন তাদের হস্টেল ক্যাম্পাসে বটগাছের তলায় গাঁজার আসরে আসছিলনা পলাশ। তাই সেদিনও ভেবেছিল, হয়তো আজকেও ওই জন্য আসেনি। তারপর দুজনের প্রেজেন্টেশন ছিল, তার চাপে খোঁজ নিতেও যাওয়া হয়নি পলাশের ঘরে। পরদিন সকালে হঠাত্ পলাশের বাবা ফোন করে বললো মাঝরাতে নাকি পলাশ কি সব মেসেজ পাঠিয়েছে ওর ঘরে গিয়ে খোঁজ নিতে। পলাশের ঘরে তারা গিয়ে দেখে একটা নিথর শরীর পড়ে আছে। শেষ শ্বাস নিচ্ছে যেন।
" পলাশ চন্দ র বাড়ির লোক কে আছেন? "
ডাক্তারের ডাকে দুজন তাড়াহুড়ো করে গেল।
"নাহ্ বাঁচানো গেলনা। "
কথাটা ডাক্তার বলা মাত্রই ডাক্তারের কলার চেপে ধরলো সুমন৷
" বাঁচানো গেলনা মানে? শূয়ার! এই তো কাল রাতে বললি একটু একটু ভেন্টিলেটর এ সাড়া দিচ্ছে "
কিরণ তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সুমনের গায়ে যেন তখন অসুরের জোর। ধ্বস্তাধস্তি তে ডাক্তারের এপ্রোন ছিঁড়ে গেল।
" তোকে দেখে নেবো, তুই বাইরে বেরো "
সুমন কে টানতে টানতে সরিয়ে নিয়ে গেল কিরণ। তখনো বকে যাচ্ছে অনর্গল৷ কিরণ এক হাতে চোখের জল মুছছে আর এক হাতে সুমন কে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷
তারপর অনেক জল গড়িয়েছে। একমাস পর পলাশকে যেখানে পোড়ানো হয়েছিল - সেই শ্মশানে বসে দুজন গাঁজা খাচ্ছে।
কিরণ বললো -
"সুমন, জানিস তো বিশ্বাস ই হচ্ছেনা মাল টা আমাদের সাথে আর নেই। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন একসাথে..."
সুমন সেদিনের হাসপাতালের ঝামেলার পর চুপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু হঠাত্
কিরণকে থামিয়ে সুমন বলে উঠলো -
" আমরা কি ওকে ফিরিয়ে আনতে পারিনা? "
কিরণ - "তুই প্ল্যানচেট করবি বলছিস !? বিশ্বাস করিস ওসবে?? "
- না, আমি ফিজিক্সে বিশ্বাস করি। এই এক মাস আমি অনেক ভেবেছি। যদি আমরা টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গিয়ে পলাশকে বলি তনুশ্রী র সাথে প্রেম না করতে তাহলে পলাশ বেঁচে থাকবে। You know that prevention is better than cure.
- দেখ্, আমি জানি তুই গাঁজা খেয়ে আছিস, তাই এসব বাজে বকছিস। হ্যাঁ গতিবেগ আলোর কাছাকাছি হলে টাইম স্লো চলে সেভাবে আমরা হয়তো ফিউচারে যেতে পারি, কিন্তু অতীতে!?
- কেন Einstein Rosen Bridge - ওয়ার্মহোল ?
- হ্যাঁ কিন্তু সেটা প্র্যাক্টিক্যালি সম্ভব নাকি!!??
- কেন নয়? নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অফ্ ইনভেনশন।
- গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স পড়েছিস তো? ধরে নেওয়া যাক কেউ অতীতে যেতে পারলো। গিয়ে তার দাদুকে মেরে দিল। তাহলে তো তার আর জন্মই হবেনা। তাহলে সে অতীতেও যেতে পারবেনা। আবার যদি অতীতে যেতে না পারে, তাহলে তার দাদুও মরবেনা। তাহলে আবার তার জন্ম হবে আর অতীতে যাবে, দাদুকে মারবে। এরকম ভাবে চলতেই থাকবে। অতীতে যাওয়া তাই সম্ভব নয়।
- না না নিশ্চয়ই অন্য কোনভাবে ভাবতে হবে, যদি আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে ভাবি স্ক্রোডিঞ্জার এর বিড়ালের মত কোন পার্টিকেল আছে বা নেই কিন্তু দুুটোই একসাথে নয় - এরকম সুপারপজিশান হলে এই প্যারাডক্স সমাধান হয়তো সম্ভব।
- ঠিক তো। চল্ খাতা পেন নিয়ে বসে পড়ি। গত সহস্র সাল মানবসভ্যতায় ড্রাগ দিয়ে মেডিসিন ম্যানেজমেন্ট এ রাজ করেছে কেমেস্ট্রি। ফিউচার অফ্ মেডিসিন হবে ফিজিক্স এন্ড ম্যাথেমেটিক্স।
এরপর দেখতে দেখতে কুড়ি বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম কোথা দিয়ে দুজন করে ফেলেছে তারা নিজেরাও জানেনা৷ তাদের গবেষণা এখন গোটা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে৷ সুমন-চন্দ-কিরণ মডেল গণিতের হিসেবে এখন পৃথিবীর ঘড়ি অনুযায়ী পাঁচ মিনিট এর জন্য একটা স্টেবল ওয়ার্মহোল বানাতে পারে যার মাধ্যমে তারা অতীতের এক প্যারালাল ইউনিভার্সে সেই সময়কালীন মানুষ হিসেবে পৌঁছে যাবে। পাঁচ মিনিট এর মধ্যে তাদের আবার ফিরে আসতে হবে এই ইউনিভার্সে। এই সময়ে না ফিরলে ওয়ার্মহোল ব্ল্যাকহোল এ রূপান্তরিত হতে পারে। ওয়ার্মহোল দিয়ে এই যাতায়াতের ফলে অতীতে যা পরিবর্তন আসবে সেটা তারা ফিরে এসে এই প্যারালাল ইউনিভার্সের টাইমলাইনে তার এফেক্ট দেখতে পাবে। পরিবর্তন শুধু নিজেদের মধ্যে নয়, গোটা ইউনিভার্সেও আসতে পারে। যেমন যে আমি অতীত এ গিয়েছে সেখানে থেকে ফিরে এসে দেখতে পারে সে অন্য কোন গ্যালাক্সির অন্য কোন গ্রহের বাসিন্দা। কিন্তু আশে পাশের মানুষগুলো একই আছে। পরিবর্তন এতটা বেশি নাও হতে পারে।
অপেক্ষা শুধু প্রথম পরীক্ষার৷ প্রথম গিনিপিগ হবে কিরণ আর সুমন নিজেরাই। কারো কোন বাধা তারা শুনবেনা। যেমন বলা তেমনি কাজ। সবকিছুই তাদের মডেল মেনে হল। শুধু তারা অতীতের ঠিক কোন সময়ে যাবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলোনা। কলেজ লাইফে ফিরে যাওয়ার অংক কষে তারা কোন এক অজানা কারণে পৌঁছে গেল ক্লাস ইলেভেন এর শুরুতে। পলাশকে ফিরে পেয়ে তাদের কি আনন্দ।
"তুই বেঁচে আছিস! " বলে লাফিয়ে উঠলো। হাতে সময় কম। তাই পলাশকে সব কথা যতটা সংক্ষেপে বলা যায় বললো। পলাশ বুঝলো যে তার উড্ বি এক্স গার্ল্ফ্রেন্ড কে তাকে ইগ্নোর করতে হবে। আর তাদের তিনজনকে ভালো করে বায়োলজি পড়তে হবে যাতে ডাক্তারীতে চান্স পেয়ে তারা মেডিসিনের ফিউচারকে বদলে দিতে পারে ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিকস এ।
দুজন যথারীতি ওয়ার্মহোল দিয়ে ঠিক সময়ে ফিরে এলো। কিন্তু ফিরে আসতে গিয়ে এবারো ঠিক সময়ে তারা ফিরতে পারলোনা। হঠাত্ দেখলো তাদের সামনে পলাশ জোরে জোরে চুটকি বাজাচ্ছে।
"কিরে কিরে, তোরা তো দেখছি দুই ছিলিম টেনেই আউট!! "
বলে হা হা করে হাসতে লাগলো।
পলাশকে ফিরে পেয়ে সুমন আর কিরণ তাকে জড়িয়ে ধরলো। আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পলাশ বললো -
" নাহ্ মালটা সলিড ছিল বুঝতে পারছি। চরম নেশা। আসলে মানুষ কেন গাঁজা পছন্দ করেনা জানিস তো? গাঁজা খেলেই লোকে শান্ত হয়ে মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করে। এই যে একটা নিউরনের সাথে আরেকটা নিউরনের কানেকশন টা ঠিক নিতে পারেনা সবাই। শুধু কি ইন্টার নিউরন ইন্টার-ইউনিভার্স কানেকশন ও হতে পারে। "
পলাশ হাসছিল। কিন্তু পলাশের শেষ কথা শুনে কিরণ আর সুমনের টনক নড়ল। তারা যে কি অসম্ভব করে ফেলেছে শুধু তারাই জানে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আবিষ্কার করলো তারা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরতে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছে আরেক প্যারালাল ইউনিভার্স এ যেখানে তারা এখন তিনজন একটা মেডিক্যাল কলেজের তিনজন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি । পলাশকে আসল কথা কিছু না বলে,
পলাশ কে ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলো সুমন -
আচ্ছা আমরা কেন মেডিক্যালে পড়তে এসেছিলাম মনে আছে তোর?
পলাশ আবার হাসতে হাসতে বললো - " মনে থাকবেনা আবার সেই ঐতিহাসিক গান্ডুগিরি !! আমি একদিন স্বপ্ন দেখলাম, তোরা দুজন নাকি ফিউচার থেকে এসে বলছিস কোন এক মেয়ের সাথে যেন আমি রিলেশনে না যাই৷ আর কিসব মেডিসিন এর ফিউচার ফিজিক্স বানাবি না কিসব বুল শিট। স্বপ্ন টা পুরোপুরি মনেও ছিলনা৷ কিন্তু সেই স্বপ্ন তোদের এসে বলতে তোরাও বার খেয়ে গেলি। তারপর তিনজন গান্ডুর মত পড়ে জয়েন্ট পেয়ে তারপর এত এত পরীক্ষা দিয়ে এই খানে বসে গাঁজা খাচ্ছি৷ "
বলে পলাশ হা হা করে হাসতে লাগলো। কিরণ আর সুমন দুজনে একবার পলাশ আর একবার নিজেদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল।
কিরণ হঠাতই চেঁচিয়ে উঠলো - তার মানে স্বপ্ন হল অন্য প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে অন্য ডাইমেনসনে তৈরি হওয়া একটা হলোগ্রাম।
সুমন বললো - চল্ খাতা পেন নিয়ে বসা যাক্। এটা প্রমাণ করতে পারলে ফ্রয়েড আর আইন্স্টাইন দুজন এসে পরলোক থেকে প্রণাম করে যাবে।
কিরণ কোথা থেকে ছুটে গিয়ে রুমে কোন খাতা না পেয়ে একটা প্রেসক্রিপশন প্যাড জোগাড় করে আনলো। কিন্তু পেন নিয়ে বসে দুজনে ৫ মিনিট ধরে অনেক কিছু ভাবলো, গণিত এর মডেল টা যেন পেট এ আসছে, কিন্তু মুখে আসছেনা।
কিরণ সুমন কে বললো - কিন্তু অংক টা করতে পারছিনা কেন ?
পলাশ আবার হা হা করে হেসে উঠলো। বললো - "তোরা শেষ। পুরো শেষ। গাঁজা টা কিছু খাঁটি৷ এবার থেকে এর কাছ থেকেই কিনবো। আমার মনে পড়ছে ফার্স্ট ইয়ার এর কথা। ফিজিওলজি লেকচার ক্লাসে ঢুকে ক্লাস না শুনে আইনথোবেনস্ ল যে ভুল সেটা প্রমাণ করার জন্য কিরণ চেষ্টা করছিল। ম্যাডাম এর ক্লাস শুনছেনা বলে পুরো খিস্তি মের বের করে দিয়েছিলেন ৷ মনে আছে তোর সুমন !!?? তারপর সুমন গেছে সিনিয়র দাদা র কাছে আইনথোবেন বুঝতে। দাদা বলছে বোঝার কি আছে৷ যোগ শিখিস নি? গাঁতিয়ে নে,গাঁতিয়ে নে। সেদিন তোদের দুজনের মুখ যেরকম ছিল আজও ঠিক সেরকম লাগছে৷ ওরে, সাত-আট বছরের গাঁতের পর কি অংক আসে? ভারতের মেডিক্যাল সায়েন্স প্যারাসিটামল আর এন্টিবায়োটিক লেখা ডাক্তার চায়, উদ্ভাবনী চিন্তা চায়না।
গাঁজা খেয়ে কি ল্যামার্ক কেও ভুলে গেলি? "
সেদিনের সেই রাত কেটে গেছে। পরেরদিন সুমন আর কিরণ এসেছে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে রাউন্ড দিতে। পার্টি মিটিং হচ্ছে। একজন পার্টি প্রচুর ঘ্যানঘ্যান করছে। বোধহয় পেশেন্ট এর কোন বন্ধু হবে - " জানেন তনুশ্রী মেয়েটার নাম। বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! "
রোগীটাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করলো তারা।
যাইহোক, আল্টিমেটলি পেশেন্ট টা বাঁচলনা। ডেথ্ ডিক্লেয়ার করতেই একজন পার্টির হাতে সুমন গালে একটা থাপ্পড় খেলো। নিজেকে একটা অদ্ভুত ডাইমেন্সনে হারিয়ে ফেললো সুমন আর
শুনতে পেল কয়েকটা কথা - " বাঁচানো গেলনা মানে? শূয়ার! এই তো কাল রাতে বললি একটু একটু ভেন্টিলেটর এ সাড়া দিচ্ছে "।
থাপ্পড় টা যেন ডেজা ভূ তে থাকা ডাঃ সুমনের গালে নয় পাঁচ মিনিটের গোলকধাঁধায় ঘুরতে থাকা পেশেন্ট পার্টি সুমনের গালে পড়ল ।।
"তোমার বন্ধুর হার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আমরা চেষ্টা করছি ফেরানোর, কিন্তু আর ৫ মিনিটে না ফিরলে আশা নেই, ৫ মিনিট পরে বলছি। "
তখন দুজনেই ভেঙে পড়ল। হ্যাঁ, দুজনেই জানে পলাশ কেন বিষ খেয়েছে। মেয়েটার নাম তনুশ্রী । সেই কলেজের প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই পলাশ কয়েকদিন এই পুরো অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। সব সময় আলাদা ঘুরে বেড়াতো একা একা, চুপচাপ। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতনা। কিন্তু এরকম যে হঠাত করে বসবে কে জানতো!!?? বেশ কিছুদিন তাদের হস্টেল ক্যাম্পাসে বটগাছের তলায় গাঁজার আসরে আসছিলনা পলাশ। তাই সেদিনও ভেবেছিল, হয়তো আজকেও ওই জন্য আসেনি। তারপর দুজনের প্রেজেন্টেশন ছিল, তার চাপে খোঁজ নিতেও যাওয়া হয়নি পলাশের ঘরে। পরদিন সকালে হঠাত্ পলাশের বাবা ফোন করে বললো মাঝরাতে নাকি পলাশ কি সব মেসেজ পাঠিয়েছে ওর ঘরে গিয়ে খোঁজ নিতে। পলাশের ঘরে তারা গিয়ে দেখে একটা নিথর শরীর পড়ে আছে। শেষ শ্বাস নিচ্ছে যেন।
" পলাশ চন্দ র বাড়ির লোক কে আছেন? "
ডাক্তারের ডাকে দুজন তাড়াহুড়ো করে গেল।
"নাহ্ বাঁচানো গেলনা। "
কথাটা ডাক্তার বলা মাত্রই ডাক্তারের কলার চেপে ধরলো সুমন৷
" বাঁচানো গেলনা মানে? শূয়ার! এই তো কাল রাতে বললি একটু একটু ভেন্টিলেটর এ সাড়া দিচ্ছে "
কিরণ তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সুমনের গায়ে যেন তখন অসুরের জোর। ধ্বস্তাধস্তি তে ডাক্তারের এপ্রোন ছিঁড়ে গেল।
" তোকে দেখে নেবো, তুই বাইরে বেরো "
সুমন কে টানতে টানতে সরিয়ে নিয়ে গেল কিরণ। তখনো বকে যাচ্ছে অনর্গল৷ কিরণ এক হাতে চোখের জল মুছছে আর এক হাতে সুমন কে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷
তারপর অনেক জল গড়িয়েছে। একমাস পর পলাশকে যেখানে পোড়ানো হয়েছিল - সেই শ্মশানে বসে দুজন গাঁজা খাচ্ছে।
কিরণ বললো -
"সুমন, জানিস তো বিশ্বাস ই হচ্ছেনা মাল টা আমাদের সাথে আর নেই। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন একসাথে..."
সুমন সেদিনের হাসপাতালের ঝামেলার পর চুপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু হঠাত্
কিরণকে থামিয়ে সুমন বলে উঠলো -
" আমরা কি ওকে ফিরিয়ে আনতে পারিনা? "
কিরণ - "তুই প্ল্যানচেট করবি বলছিস !? বিশ্বাস করিস ওসবে?? "
- না, আমি ফিজিক্সে বিশ্বাস করি। এই এক মাস আমি অনেক ভেবেছি। যদি আমরা টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গিয়ে পলাশকে বলি তনুশ্রী র সাথে প্রেম না করতে তাহলে পলাশ বেঁচে থাকবে। You know that prevention is better than cure.
- দেখ্, আমি জানি তুই গাঁজা খেয়ে আছিস, তাই এসব বাজে বকছিস। হ্যাঁ গতিবেগ আলোর কাছাকাছি হলে টাইম স্লো চলে সেভাবে আমরা হয়তো ফিউচারে যেতে পারি, কিন্তু অতীতে!?
- কেন Einstein Rosen Bridge - ওয়ার্মহোল ?
- হ্যাঁ কিন্তু সেটা প্র্যাক্টিক্যালি সম্ভব নাকি!!??
- কেন নয়? নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অফ্ ইনভেনশন।
- গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স পড়েছিস তো? ধরে নেওয়া যাক কেউ অতীতে যেতে পারলো। গিয়ে তার দাদুকে মেরে দিল। তাহলে তো তার আর জন্মই হবেনা। তাহলে সে অতীতেও যেতে পারবেনা। আবার যদি অতীতে যেতে না পারে, তাহলে তার দাদুও মরবেনা। তাহলে আবার তার জন্ম হবে আর অতীতে যাবে, দাদুকে মারবে। এরকম ভাবে চলতেই থাকবে। অতীতে যাওয়া তাই সম্ভব নয়।
- না না নিশ্চয়ই অন্য কোনভাবে ভাবতে হবে, যদি আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে ভাবি স্ক্রোডিঞ্জার এর বিড়ালের মত কোন পার্টিকেল আছে বা নেই কিন্তু দুুটোই একসাথে নয় - এরকম সুপারপজিশান হলে এই প্যারাডক্স সমাধান হয়তো সম্ভব।
- ঠিক তো। চল্ খাতা পেন নিয়ে বসে পড়ি। গত সহস্র সাল মানবসভ্যতায় ড্রাগ দিয়ে মেডিসিন ম্যানেজমেন্ট এ রাজ করেছে কেমেস্ট্রি। ফিউচার অফ্ মেডিসিন হবে ফিজিক্স এন্ড ম্যাথেমেটিক্স।
এরপর দেখতে দেখতে কুড়ি বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম কোথা দিয়ে দুজন করে ফেলেছে তারা নিজেরাও জানেনা৷ তাদের গবেষণা এখন গোটা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে৷ সুমন-চন্দ-কিরণ মডেল গণিতের হিসেবে এখন পৃথিবীর ঘড়ি অনুযায়ী পাঁচ মিনিট এর জন্য একটা স্টেবল ওয়ার্মহোল বানাতে পারে যার মাধ্যমে তারা অতীতের এক প্যারালাল ইউনিভার্সে সেই সময়কালীন মানুষ হিসেবে পৌঁছে যাবে। পাঁচ মিনিট এর মধ্যে তাদের আবার ফিরে আসতে হবে এই ইউনিভার্সে। এই সময়ে না ফিরলে ওয়ার্মহোল ব্ল্যাকহোল এ রূপান্তরিত হতে পারে। ওয়ার্মহোল দিয়ে এই যাতায়াতের ফলে অতীতে যা পরিবর্তন আসবে সেটা তারা ফিরে এসে এই প্যারালাল ইউনিভার্সের টাইমলাইনে তার এফেক্ট দেখতে পাবে। পরিবর্তন শুধু নিজেদের মধ্যে নয়, গোটা ইউনিভার্সেও আসতে পারে। যেমন যে আমি অতীত এ গিয়েছে সেখানে থেকে ফিরে এসে দেখতে পারে সে অন্য কোন গ্যালাক্সির অন্য কোন গ্রহের বাসিন্দা। কিন্তু আশে পাশের মানুষগুলো একই আছে। পরিবর্তন এতটা বেশি নাও হতে পারে।
অপেক্ষা শুধু প্রথম পরীক্ষার৷ প্রথম গিনিপিগ হবে কিরণ আর সুমন নিজেরাই। কারো কোন বাধা তারা শুনবেনা। যেমন বলা তেমনি কাজ। সবকিছুই তাদের মডেল মেনে হল। শুধু তারা অতীতের ঠিক কোন সময়ে যাবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলোনা। কলেজ লাইফে ফিরে যাওয়ার অংক কষে তারা কোন এক অজানা কারণে পৌঁছে গেল ক্লাস ইলেভেন এর শুরুতে। পলাশকে ফিরে পেয়ে তাদের কি আনন্দ।
"তুই বেঁচে আছিস! " বলে লাফিয়ে উঠলো। হাতে সময় কম। তাই পলাশকে সব কথা যতটা সংক্ষেপে বলা যায় বললো। পলাশ বুঝলো যে তার উড্ বি এক্স গার্ল্ফ্রেন্ড কে তাকে ইগ্নোর করতে হবে। আর তাদের তিনজনকে ভালো করে বায়োলজি পড়তে হবে যাতে ডাক্তারীতে চান্স পেয়ে তারা মেডিসিনের ফিউচারকে বদলে দিতে পারে ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিকস এ।
দুজন যথারীতি ওয়ার্মহোল দিয়ে ঠিক সময়ে ফিরে এলো। কিন্তু ফিরে আসতে গিয়ে এবারো ঠিক সময়ে তারা ফিরতে পারলোনা। হঠাত্ দেখলো তাদের সামনে পলাশ জোরে জোরে চুটকি বাজাচ্ছে।
"কিরে কিরে, তোরা তো দেখছি দুই ছিলিম টেনেই আউট!! "
বলে হা হা করে হাসতে লাগলো।
পলাশকে ফিরে পেয়ে সুমন আর কিরণ তাকে জড়িয়ে ধরলো। আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পলাশ বললো -
" নাহ্ মালটা সলিড ছিল বুঝতে পারছি। চরম নেশা। আসলে মানুষ কেন গাঁজা পছন্দ করেনা জানিস তো? গাঁজা খেলেই লোকে শান্ত হয়ে মহাবিশ্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করে। এই যে একটা নিউরনের সাথে আরেকটা নিউরনের কানেকশন টা ঠিক নিতে পারেনা সবাই। শুধু কি ইন্টার নিউরন ইন্টার-ইউনিভার্স কানেকশন ও হতে পারে। "
পলাশ হাসছিল। কিন্তু পলাশের শেষ কথা শুনে কিরণ আর সুমনের টনক নড়ল। তারা যে কি অসম্ভব করে ফেলেছে শুধু তারাই জানে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আবিষ্কার করলো তারা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরতে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছে আরেক প্যারালাল ইউনিভার্স এ যেখানে তারা এখন তিনজন একটা মেডিক্যাল কলেজের তিনজন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি । পলাশকে আসল কথা কিছু না বলে,
পলাশ কে ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলো সুমন -
আচ্ছা আমরা কেন মেডিক্যালে পড়তে এসেছিলাম মনে আছে তোর?
পলাশ আবার হাসতে হাসতে বললো - " মনে থাকবেনা আবার সেই ঐতিহাসিক গান্ডুগিরি !! আমি একদিন স্বপ্ন দেখলাম, তোরা দুজন নাকি ফিউচার থেকে এসে বলছিস কোন এক মেয়ের সাথে যেন আমি রিলেশনে না যাই৷ আর কিসব মেডিসিন এর ফিউচার ফিজিক্স বানাবি না কিসব বুল শিট। স্বপ্ন টা পুরোপুরি মনেও ছিলনা৷ কিন্তু সেই স্বপ্ন তোদের এসে বলতে তোরাও বার খেয়ে গেলি। তারপর তিনজন গান্ডুর মত পড়ে জয়েন্ট পেয়ে তারপর এত এত পরীক্ষা দিয়ে এই খানে বসে গাঁজা খাচ্ছি৷ "
বলে পলাশ হা হা করে হাসতে লাগলো। কিরণ আর সুমন দুজনে একবার পলাশ আর একবার নিজেদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল।
কিরণ হঠাতই চেঁচিয়ে উঠলো - তার মানে স্বপ্ন হল অন্য প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে অন্য ডাইমেনসনে তৈরি হওয়া একটা হলোগ্রাম।
সুমন বললো - চল্ খাতা পেন নিয়ে বসা যাক্। এটা প্রমাণ করতে পারলে ফ্রয়েড আর আইন্স্টাইন দুজন এসে পরলোক থেকে প্রণাম করে যাবে।
কিরণ কোথা থেকে ছুটে গিয়ে রুমে কোন খাতা না পেয়ে একটা প্রেসক্রিপশন প্যাড জোগাড় করে আনলো। কিন্তু পেন নিয়ে বসে দুজনে ৫ মিনিট ধরে অনেক কিছু ভাবলো, গণিত এর মডেল টা যেন পেট এ আসছে, কিন্তু মুখে আসছেনা।
কিরণ সুমন কে বললো - কিন্তু অংক টা করতে পারছিনা কেন ?
পলাশ আবার হা হা করে হেসে উঠলো। বললো - "তোরা শেষ। পুরো শেষ। গাঁজা টা কিছু খাঁটি৷ এবার থেকে এর কাছ থেকেই কিনবো। আমার মনে পড়ছে ফার্স্ট ইয়ার এর কথা। ফিজিওলজি লেকচার ক্লাসে ঢুকে ক্লাস না শুনে আইনথোবেনস্ ল যে ভুল সেটা প্রমাণ করার জন্য কিরণ চেষ্টা করছিল। ম্যাডাম এর ক্লাস শুনছেনা বলে পুরো খিস্তি মের বের করে দিয়েছিলেন ৷ মনে আছে তোর সুমন !!?? তারপর সুমন গেছে সিনিয়র দাদা র কাছে আইনথোবেন বুঝতে। দাদা বলছে বোঝার কি আছে৷ যোগ শিখিস নি? গাঁতিয়ে নে,গাঁতিয়ে নে। সেদিন তোদের দুজনের মুখ যেরকম ছিল আজও ঠিক সেরকম লাগছে৷ ওরে, সাত-আট বছরের গাঁতের পর কি অংক আসে? ভারতের মেডিক্যাল সায়েন্স প্যারাসিটামল আর এন্টিবায়োটিক লেখা ডাক্তার চায়, উদ্ভাবনী চিন্তা চায়না।
গাঁজা খেয়ে কি ল্যামার্ক কেও ভুলে গেলি? "
সেদিনের সেই রাত কেটে গেছে। পরেরদিন সুমন আর কিরণ এসেছে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে রাউন্ড দিতে। পার্টি মিটিং হচ্ছে। একজন পার্টি প্রচুর ঘ্যানঘ্যান করছে। বোধহয় পেশেন্ট এর কোন বন্ধু হবে - " জানেন তনুশ্রী মেয়েটার নাম। বিষ টা খাওয়ার আগে একবার আমাকে বলতো!! "
রোগীটাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করলো তারা।
যাইহোক, আল্টিমেটলি পেশেন্ট টা বাঁচলনা। ডেথ্ ডিক্লেয়ার করতেই একজন পার্টির হাতে সুমন গালে একটা থাপ্পড় খেলো। নিজেকে একটা অদ্ভুত ডাইমেন্সনে হারিয়ে ফেললো সুমন আর
শুনতে পেল কয়েকটা কথা - " বাঁচানো গেলনা মানে? শূয়ার! এই তো কাল রাতে বললি একটু একটু ভেন্টিলেটর এ সাড়া দিচ্ছে "।
থাপ্পড় টা যেন ডেজা ভূ তে থাকা ডাঃ সুমনের গালে নয় পাঁচ মিনিটের গোলকধাঁধায় ঘুরতে থাকা পেশেন্ট পার্টি সুমনের গালে পড়ল ।।